হযরত ইয়াকূব (আ)

জন্ম ও বংশপরিচয়

হযরত ইয়াকুব (আ) আনু. ১৮৩৬ খৃ. পূ. সালে কান্‌আন (বর্তমান ফিলিস্তীন)-এ জন্মগ্রহণ করেন (বাইবেল ডিকশনারী, পৃ. ২৩)। তাঁহার সময়কাল সাধারণ হিসাব অনুসারে খৃ. পূ. ১৮শ শতক (Colliers Encyclopedia, ১৩ খ., পৃ. ৪২৭) এবং তাফসীরে মাজেদীর বর্ণনামতে খ্র. পূ. ২০০০ সাল হইতে ১৮৫৩ খৃ. পূ. (১খ., পৃ. ২৪৬, টীকা ৪৭৫, ই. ফা.-র বাংলা সং)। তিনি ছিলেন হযরত ইসহাক (আ)-এর পুত্র এবং হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পৌত্র। এই বংশলতিকা  কুরআন মজীদ কর্তৃক স্বীকৃত। মহান আল্লাহ বলেন :

“আমি ইবরাহীমকে দান করিয়াছিলাম ইসহাক এবং অতিরিক্ত পৌত্ররূপে ইয়াকূব” (দ্র. ২১ : ৭২)।

হাদীস শরীফে ইহার প্রমাণ বিদ্যমান। রাসূলুল্লাহ (স) এক ব্যক্তির জিজ্ঞাসার উত্তরে বলেন :

“সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তি হইলেন আল্লাহর নবী ইউসুফ, তিনি ছিলেন আল্লাহর নবী (ইয়াকূব)-এর পুত্র, ইয়াকূব (আ) ছিলেন আল্লাহর নবী (ইসহাক)-এর পুত্র” (বুখারী, ১খ., পৃ. ৪৭৮, কিতাবুল আম্বিয়া, বাব ১৫; মুসলিম, ফাদাইল, বাংলা অনু., ৭খ., পৃ. ৩৬৮)।

বুখারীর অন্যত্র হাদীছটি এভাবে বর্ণিত হইয়াছে :

“ইবন উমার (রা) হইতে বর্ণিত। নবী (স) বলেন : মর্যাদাবান ব্যক্তি, মর্যাদাবান ব্যক্তির পুত্র, মর্যাদাবান ব্যক্তির পুত্র, মর্যাদাবান ব্যক্তির পুত্র ইউসুফ ইব্‌ন ইয়াকূব ইবন ইসহাক ইব্‌ন ইবরাহীম আলায়হিমুস সালাম (আম্বিয়া, বাব ১৯, নং ৩১৩২, ৩, পৃ. ৩৭২; আরও দ্র. তাফসীর সূরা ১২, নং ৪৩২৭, ৪খ., পৃ. ৪৩০)।

তাহার মাতার নাম রিকা (রিকা)। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার জমজ সন্তান। বাইবেলের ব্যাখ্যা অনুসারে ইয়াকূব (পাদগ্ৰাহী) শব্দটি হিব্রু বিশেষ্যপদ ‘আকিব (পায়ের গোছা) হইতে গৃহীত। কারণ তিনি তাঁহার মাতার গর্ভ হইতে তাঁহার জমজ ভ্রাতা এসূ-এর পাদমূল ধরিয়া ভূমিষ্ঠ হন (দ্র. বাইবেলের আদিপুস্তক, ২৫ ও ২৬)। আরবী ভাষায়ও উক্ত শব্দের অর্থ পায়ের গোছা ও পশ্চাদবর্তী (দ্র. অভিধান)।

হযরত ইয়াকূব (আ) ও তাঁহার পিতা হযরত ইসহাক (আ) ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ) ও তাঁহার স্ত্রী সারার জন্য আল্লাহ তাআলার দানস্বরূপ । এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন :

“আর আমি তাহাকে দান করিয়াছিলাম ইসহাক ও ইয়াকূব, ইহাদের প্রত্যেককে আমি সৎপথে পরিচালিত করিয়াছিলাম” (৬ ও ৮৪; আরও দ্র. ২১ : ৭২; ২৯ ও ২৭; ১১ : ৭১)।

কতক তাফসীরকারের মতে হযরত ইয়াকূব (আ) তাঁহার দাদা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর জীবদ্দশায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহারা সূরা বাকারার ১৩২ নম্বর আয়াতে উদ্ধৃত ইয়াকূব শব্দটিকে মাফউল (কর্মকারক)-এর পরিবর্তে ফাইল (কর্তৃকারক) হিসাবে পাঠ করেন। আয়াতটি নিম্নরূপঃ

“এবং ইবরাহীম ও ইয়াকূব এই সম্বন্ধে তাহাদের পুত্রগণকে ওসিয়ত করিয়াছিলেন” (২৪ ১৩২)।

ইহা হইল আয়াতের সর্বজনগ্রাহ্য অর্থ। কিন্তু ইয়াকূবকে মাফউল সাব্যস্ত করিলে আয়াতের অর্থ হয় : “এবং ইবরাহীম এই সম্বন্ধে তাহার পুত্রগণকে ও ইয়াকূবকে ওসিয়াত করিয়াছিলেন। তাফসীরে ইব্‌ন কাছীর-এ এই মতকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হইয়াছে এবং ইহার সমর্থনে ইব্‌ন কাছীর ১১৪ ৭১; ২৯ : ২৭ ও ২১ : ৭২ আয়াতত্রয় পেশ করিয়াছেন। উক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-কে দান করিয়াছেন বলা হইয়াছে। আর দান তো জীবদ্দশায়ই হইয়া থাকে (বিস্তারিত দ্র. তাফসীরে ইবন কাছীর, বাংলা অনু., ১খ., পৃ. ৫৭৩; বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)।

বাইবেল ও বাইবেল ভিত্তিক রচনাবলীর বর্ণনা অনুসারে হযরত ইসহাক (আ) এসূকে অধিক স্নেহ করিতেন এবং স্ত্রী রিক্কা অপর পুত্র ইয়াকূবকে অধিক স্নেহ করিতেন। এক পর্যায়ে রেষারেষির সৃষ্টি হইলে মাতা তাহাকে নিজ ভ্রাতা লাভান-এর নিকট হাররান বা পাদ্দান আরাম (বর্তমান উত্তর মেসোপটামিয়া)-এ পাঠাইয়া দেন (বাইবেলের আদিপুস্তক, ২৭ : ৪১-৬) তথায় তিনি মামার মেষপাল চরাইতেন। ইহার দ্বারা মহানবী (স)-এর একটি বাণী স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণিত হয়। তিনি বলেন : “এমন কোন নবী নাই যিনি মেষপাল চরান নাই”। সেখানে তিনি এক পর্যায়ে দুই সহোদর মামাতো বোনকে বিবাহ করেন এবং পরবর্তী কালে দুই স্ত্রী ও তাহাদের দুই দাসীকে লইয়া কাননে প্রত্যাবর্তন করেন। তৎকালীন শরীআতে দুই সহোদরাকে একইসঙ্গে বিবাহ করা বৈধ ছিল। এজন্যই আল্লাহ তাআলা বলিয়াছেনঃ

“এবং আরও এই যে, দুই ভগিনীকে একত্রে বিবাহ করা, পূর্বে যাহা হইয়াছে তো হইয়াছে” (৪ : ২৩; আল-কামিল, ১খ., পৃ. ৯৬)।

মামার বাড়িতে যাওয়ার পথে তিনি এক স্থানে যাত্রাবিরতি করিলেন এবং রাত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্ন দেখিতে পাইলেন যে, আল্লাহ তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “আমি সদাপ্রভু, তোমার পূর্বপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের প্রতিপালক প্রভু। তুমি যে ভূমিতে শুইয়া আছ, ইহা আমি তোমাকে ও তোমার বংশধরগণকে দান করিব ….” (দ্র. বাইবেলের আদিপুস্তক, ২৮ : ১০-২২)।

ইব্‌ন কুতায়বা আদ-দীনাওয়ারীর মতে স্বপ্নের বিষয়বস্তু এই যে, মহামহিম আল্লাহ তাঁহার নিকট ওহী পাঠাইলেন যে, “আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত কোনও ইলাহ নাই, তোমার ইলাহ এবং তোমার পূর্বপুরুষগণের ইলাহ। আমি তোমাকে এই পবিত্র ভূমির উত্তরাধিকারী বানাইলাম এবং তোমার পরে তোমার বংশধরগণকেও। আমি তোমাকে ও তাহাদেরকে প্রাচুর্য দান করিলাম, তোমাদের মধ্যে কিতাব, হিকমাত ও নবওয়াত দান করিলাম। আমি এই স্থানে পৌঁছা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আছি এবং আমি তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিলাম। তুমি ইহাতে একটি ঘর বানাও যাহাতে তুমি ও তোমার বংশধরগণ আমার ইবাদত করিবে। ইহাই বায়তুল মাকদিস” (আল-মাআরিফ, পৃ. ২৩)।

 কুরআন মজীদে হযরত ইয়াকুব (আ)

কুরআন মজীদে নামসহ খোলবার হযরত ইয়াকূব (আ)-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হইয়াছে এবং সর্বনামরূপে আরও কয়েক স্থানে তাহার প্রসঙ্গ আসিয়াছে। যেমন ২ : ১৩২, ১৩৩, ১৩৬, ১৪০; ৩ : ৮৪; ৪ : ১৬৩; ৬ ও ৮৪; ১১ ও ৭১; ১২ : ৬, ৩৮, ৬৮; ১৯ ও ৬, ৪৯; ২১ : ৭২; ২৯ : ২৭; ১৮: ৪৫। এইসব স্থানে হযরত ইয়াকূব (আ) সম্পর্কে যে তথ্যাবলী উক্ত আছে তাহা মূল পাঠসহ নিবন্ধের সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে উদ্ধৃত হইয়াছে।

ইয়াকুব (আ)-এর বৈবাহিক জীবন ও সন্তান-সন্তুতি

ইয়াকূব (আ) মাতুলালয়ে পৌঁছিয়া তাহার গবাদিপশু লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মামার দুই কন্যা ছিল, বড়জনের নাম লিয়া এবং ছোটজনের নাম রাহীল। সাত বৎসর পর ইয়াকূব (আ) মামার ছোট কন্যা রাহীলকে বিবাহ করিতে আগ্রহ প্রকাশ করিলেন। কিন্তু মামা তাঁহার সহিত জ্যেষ্ঠা কন্যা লিয়ার বিবাহ দিলেন। কারণ জ্যেষ্ঠা কন্যাকে অবিবাহিত রাখিয়া কনিষ্ঠা কন্যার বিবাহদান তাহাদের রীতিবিরুদ্ধ ছিল (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)। অবশ্য পরে আরো সাত বৎসর (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫; বাইবেলের আদিপুস্তক, ২৯ ও ২৭) মামার পশুপাল চরাইবার পর তিনি তাহার কাঙ্খিত মামাত ভগিনী রাহীলকেও বিবাহ করিতে সক্ষম হইলেন। তৎকালে একত্রে দুই বোনকে বিবাহ করা বৈধ ছিল। তাহার কন্যা লিয়ার সহিত জুলফা (সিল্পা) ও রাহীলের সহিত বিলহা নাম্বী দুইটি দাসীও দান করেন। পরে দুই স্ত্রী স্ব স্ব দাসীকেও ইয়াকূব (আ)-এর সহিত বিবাহ দেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)।

আল্লাহ্ তাআলা এই চারজন স্ত্রীর গর্ভে ইয়াকূব (আ)-কে দ্বাদশ পুত্র ও এক কন্যা সন্তান দান করেন। প্রথম স্ত্রী লিয়ার গর্ভে রূবিল (রূবেন=পুত্রকে দেখ), শামউন (শিমিয়ন=শ্রবণ), লাবী (লেবী=আসক্ত), ইয়াহূ (যিহূদা=স্তব), ঈসাখর, অপর বর্ণনায় ইব্‌নসাখর (ইযাখর=বেতন) ও যাঈন (সবুলুন= বসবাস) নামে পাঁচ পুত্র সন্তান এবং রাহীলের গর্ভে হযরত ইউসুফ (যোশেফ= বৃদ্ধি) ও বিনয়ামীন (বিন্যামিন=দক্ষিণ হস্তের পুত্র), তৃতীয় স্ত্রী এবং রাহীলের দাসী বিলহার গর্ভে দান (বিচার) ও নাফতালী (মল্লযুদ্ধ), চতুর্থ স্ত্রী এবং লিয়ার দাসী যুলফার গর্বে জাদ, অপর বর্ণনায় হায় (গাদ=সৌভাগ্য) ও আশীর (ধন্য) জন্মগ্রহণ করে (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৭; আরও দ্র. পৃ. ১৯৫; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯৫-৬; তাফসীরে তাবারী, বাংলা অনু., ২খ, পৃ. ৩৬৭-৮; বাইবেলের আদিপুস্তক, ২৯ ও ৩২-৩৫; ৩০ : ১-২৪; ৩৫ : ১৮ ও ২৩-২৬)। বিনয়ামীন ব্যতীত ইয়াকূব (আ)-এর সকল সন্তান তাঁহার মাতুলালয় হাররানে (তাবারীর মতে বাবিলে) জন্মগ্রহণ করেন।

ইয়াকূব (আ)-এর উসীলায় আল্লাহ্ তাআলা তাঁহার মামার সম্পদে, বিশেষত গবাদিপশুতে প্রচুর বরকত ও প্রাচুর্য দান করেন। তিনি মোট বিশ বৎসর মাতুলালয়ে অবস্থান করেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)। পরে আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে ইয়াকূব (আ)-কে তাঁহার পিতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দান করেন এবং তাঁহাকে সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)। তদনুযায়ী তিনি সপরিবারে প্রচুর সম্পদসহ পিতৃভূমি হেব্রনে ফিরিয়া আসেন। আসার পথে রাহীল “আফরাছ” (ইফরাত বা বেথেলহাম) নামক স্থানে বিনয়ামীনকে প্রসব করার পরপরই ইনতিকাল করেন। ইয়াকূব (আ) তাহাকে এখানেই দাফন করেন এবং তাহার কবরের উপর একটি প্রস্তর স্তম্ভ স্থাপন করেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৭; বাইবেলের আদিপুস্তক, ৩৫ ও ১৬-২০)।