হযরত ইবরাহীম (আ)

হযরত ইবরাহীম (আ) একজন বিশিষ্ট নবী ও রাসূল। মুসলিম জাতির আদি পিতা (কুরআন, ২২ ও ৭৮)। আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে কয়েকটি বিষয়ে কঠিন পরীক্ষা করেন। সকল পরীক্ষাতেই তিনি সফলতার সহিত উত্তীর্ণ হন (২ ও ১২৪)। এইজন্য তিনি আল্লাহ তাআলার খুবই প্রিয়ভাজন হন। আল্লাহ তাঁহাকে বিশেষ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন (৪:১২৫)। তাই তাঁহার উপাধি হয় খালীলুল্লাহ (আল্লাহ্ বিশেষ বন্ধু)। তিনি মেহমানদারিতে খুবই প্রসিদ্ধ ছিলেন বলিয়া তাহার উপনাম হয় ‘আবুদ-দায়ফীন অর্থাৎ মেহমানদের পিতা (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১৩, ১৪০)।

বাইবেলের বর্ণনামতে তাঁহার পূর্বনাম ছিল আবরাম অর্থাৎ মহাপিতা। তাঁহার ৯৯ বৎসর বয়সে সদাপ্রভু তাঁহাকে দর্শন দান করত তাহার নাম রাখেন ‘আবরাহাম অর্থাৎ বহু লোকের বা জাতির পিতা (Genesis, 17:5)। পরবর্তী কালের অনেক গবেষকই এই বিশ্লেষণ করিয়াছেন যে, ইবরাহীম বা আবরাহাম হিব্রু শব্দ, যাহা ‘আব (পিতা) ও রাহাম (দল বা অধিকাংশ লোক) শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত, যাহার অর্থ বহু দল বা অধিকাংশ লোকের পিতা। ইহা অনারব শব্দ (বুতরু আল-বুসতানী, দাইরাতুল-মাআরিফ, ১খ, ২০৮)।

আবির্ভাবকাল

হযরত ইবরাহীম (আ) কখন দুনিয়াতে আবির্ভূত হইয়াছিলেন তাহা একেবারে সঠিক করিয়া বলা না গেলেও বিভিন্ন বর্ণনা হইতে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া যায়। সবগুলি বর্ণনাই প্রায় একই রকম। অধিকাংশের বর্ণনামতে হযরত নূহ (আ)-এর প্লাবন হইতে ১২৬৩ (মতান্তরে ১০৯৯) বৎসর পর তিনি আবির্ভূত হন এবং হযরত আদম (আ) হইতে ৩৩৩০ (এক বর্ণনায় ৩৩৩৭) বৎসর পর (ইবনুল জাওযী, আল-মুনতাজাম, ১খ, ২৫৮; আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ.৭৬)। আবু উমামা (রা) বর্ণনা করেন যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (স)-কে জিজ্ঞাসা করিল, নূহ (আ) ও ইবরাহীম (আ)-এর মধ্যে কত ব্যবধান। তিনি বলিলেন, দশ কারূন (প্রজন্ম) (ইনুল-জাওযী, প্রাগুক্ত)। উল্লেখ্য যে, প্রতি ১০০ (এক শত) বৎসরকে এক কারূন বলা হয়। ইবন হাবীব তাহার আল-মুহাব্বার গ্রন্থে ইবন আব্বাস (রা) হইতে একটি রিওয়ায়াত উদ্ধৃত করিয়াছেন। উহাতে এইভাবে হিসাব প্রদান করা হইয়াছে যে, হযরত আদম (আ) হইতে নূহ (আ)-এর সময়কাল ২২২০ (দুই হাজার দুই শত বিশ) বৎসর, নূহ (আ) হইতে ইবরাহীম (আ) পর্যন্ত ১১৪৩ মতান্তরে ১১৬৫ বৎসর। তদনুযায়ী হযরত আদম (আ) হইতে ইবরাহীম (আ)-এর সময়কাল ৩৩৪৩ বা ৩৩৬৫ বৎসর (ইবন হাবীব, আল-মুহাব্বার, পৃ. ১)। ইবন কুতায়বার বর্ণনায় হযরত নূহ (আ) ও ইবরাহীম (আ)-এর মধ্যে ব্যবধান এই সকল বর্ণনা হইতে একটু বেশী বলিয়া পরিদৃষ্ট হয়। তাঁহার বর্ণনামতে উভয়ের মধ্যে ২২৪০ বৎসরের ব্যবধান (আল-মাআরিফ, পৃ. ৩১)। অনেকের মতে তিনি খৃ.পূ. ২০১৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং আর্চবিশপের মতে খৃ.পূ. ১৯৯৬ সালে। তবে প্রথম মতটিই যুক্তিযুক্ত (আনওয়ার-ই আম্বিয়া, পৃ. ৪৬)।

তৎকালীন বাদশাহ নমরূদের পরিচয়

অধিকাংশ ইতিহাসবিদ-এর মতে হযরত ইবরাহী (আ) পরাক্রমশালী বাদশাহ নমরূদ ইবন কূশ মতান্তরে কিনআন ইবন কূশ-এর আমলে জন্মগ্রহণ করেন। কাহারও কাহারও মতে সে ইযদিহাক-এর গভর্নর ছিল। কিন্তু অধিকাংশের মতে সে নিজেই বাদশাহ ছিল। ইব্‌ন ইসহাক বলেন, তাহার রাজত্ব পূর্ব হইতে পশ্চিমে বিস্তৃত ছিল। সে বাবিলে বসবাস করিত। কথিত আছে যে, সমগ্র বিশ্বের রাজত্ব করেন তিন বক্তি ও নমরূদ, যুল-কারনায়ন ও সুলায়মান ইব্‌ন দাউদ (আ)। কেহ কেহ বুখত নসরকেও ইহাদের অন্তর্ভুক্ত করিয়া চারজনের কথা বলিয়াছেন, কিন্তু ইবনুল-আমীর উহা বাতিল বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন (আল-কামিল, ১৩, ৭২)। তাহার বংশলতিকা হইল : নমরূদ ইব্‌ন কিনআন ইবন কূশ ইব্‌ন সাম ইব্‌ন নূহ (আত-তাবারী, তারীখ, ১৩, ১১৯)। সে-ই প্রথম স্বেচ্ছাচারী ও কঠোর আচরণকারী রাজা ছিল। সে বিবিধ ধরনের খারাপ আদর্শের প্রচলন করে। প্রথম মাথায় তাজ (রাজমুকুট) পরিধান করে, শয়তানের সহায়তায় জ্যোতির্বিদ্যার প্রসার ঘটায় এবং তারকার প্রতি দৃষ্টিপাত করত উহা পর্যবেক্ষণ করিয়া ভূত-ভবিষ্যৎ গণনা করিতে শুরু করে (ইব্‌ন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, পৃ. ৩১) এবং এই কাজে কিছু লোক নিয়োজিত করে, যাহারা কাহিন (গণক) ও মুনাজজিম (জ্যোতিষী) নামে পরিচিত। সে-ই প্রথম লোকজনকে তাহার পূজা করিতে উদ্বুদ্ধ করে এবং নিজকে ক্ষমতাধর বিধাতা বলিয়া দাবি করে, আল্লাহর অবাধ্যতা ও বিরোধিতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে। এক বর্ণনামতে তাহার সময়ই অগ্নিপূজার প্রচলন হয় এবং জ্যোতির্বিদ্যার উদ্ভব ঘটে (আল-মাসউদী, মুরূজুয-যাহাব, ১খ, ৪৪)। আল্লাহ তাআলা তাহাকে দীর্ঘ জীবন দান করেন। দীর্ঘদিন সে রাজত্ব করে (এক বর্ণনামতে চারি শত বৎসর)। কোনও দলীল-প্রমাণই তাহাকে গোমরাহী হইতে ফিরাইতে পারে নাই। অবশেষে তাহাকে ধ্বংস করিবার জন্য আল্লাহ তাআলা মশক বাহিনী প্রেরণ করেন। এত অধিক পরিমাণে মশা বাহির হয় যে, সূর্যকে পর্যন্ত আড়াল করিয়া ফেলে । মশক বাহিনী নমরূদের সেনাবাহিনীর রক্ত মাংস খাইয়া ফেলিল, শুধুমাত্র হাড্ডিগুলি অবশিষ্ট রহিল। অবশেষে একটি মশা নমরূদের নাক দিয়া মগজে ঢুকিয়া পড়িল। সেখানে নানারূপ উৎপাত করিয়া নমরুদকে অস্থির করিয়া ফেলিত। তাই সর্বদাই হাতুড়ি দ্বারা তাহার মস্তক পিটাইতে হইত। মানুষ তাহার প্রতি এইভাবে দয়া প্রদর্শন করিত যে, দুই হাত দিয়া অনবরত সজোরে তাহার মাথায় আঘাত করিতে থাকিত। এইভাবে আরো চারি শত বৎসর জীবিত থাকিয়া শাস্তি ভোগ করে (মতান্তরে ৪০ বৎসর, কাহারো বর্ণনামতে ৪০ দিন)। এইরূপ অপদস্থ অবস্থায় তাহার মৃত্যু হয় (ইবনুল-জাওযী, আল-মুনতাজাম, ১খ, ২৮০-২৮১; ইব্‌ন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, পৃ. ৩১; মুহাম্মাদ আল-ফাকী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ.৭৭)।

ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম ও বংশপরিচয়

তাঁহার জন্মস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। কাহারও মতে তিনি আহওয়ায় প্রদেশের সূস নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন, কাহারও মতে কৃছার পার্শ্ববর্তী সাওয়াদ নামক স্থানে। কাহারও মতে যাওয়াবী ও কাসকার সীমান্তের পার্শ্ববর্তী ওয়ারকা নামক স্থানে। অতঃপর তাঁহার পিতা কৃছার যে প্রান্তে নমরূদ বসবাস করিত তাহাকে সেখানে লইয়া যায়। কাহারও মতে হাররান নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর তাঁহার পিতা তাঁহাকে বাবিলে লইয়া আসে (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ১১৯; আছ-ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৬)। হাফিয ইব্‌ন আসাকির তাঁহার জন্মস্থান সম্পর্কে দুইটি মত উদ্ধৃত করিয়াছেন এবং বাবিলকেই সঠিক বলিয়া রায় দিয়াছেন। তিনি হিশাম ইবন আম্মার সূত্রে ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম (আ) দামিশক-এর বার নামক শস্য-শ্যামল গ্রামের কাসিয়ূন পর্বতের পাদদেশে জন্মগ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি বলেন, তবে সঠিক হইল তিনি বাবিলে জন্মগ্রহণ করেন। উপরিউক্ত স্থানের কথা এইজন্য তাঁহার প্রতি আরোপ করা হইয়াছে যে, লুত (আ)-এর সহায়তাকল্পে তিনি যখন সেখানে গমন করেন তখন সেখানে সালাত আদায় করেন (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১৩, ১৪০; মুহাম্মাদ আল-ফাকী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬১)। খ্যাতনামা ভূগোলবিদ য়াক্ত আল-হামারী ও আল-বাকরী আল-আদালুসীর বর্ণনা হইতেও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। তাহাদের বর্ণনামতে বাবিলে অবস্থিত কৃছা রাব্বা নামক স্থানেই ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করেন, সেখানেই তাঁহাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয় (য়াকুত আল-হাবী, মুজামুল-বুলদান, ৪খ, ৪৮৭; আল-বাকরী আল-আনদালুসী, মুজামু মাসতাজাম, ৪খ, ১১৩৮)।

ইবন ইসহাক-এর বর্ণনামতে হযরত নূহ (আ) ও ইবরাহীম (আ)-এর মধ্যখানে মাত্র দুইজন নবী হূদ (আ) ও সালিহ (আ) আগমন করেন। তাঁহাদের সময়কাল শেষ হওয়ার পর মানুষ যখন চরম গোমরাহী ও শিরক-এ লিপ্ত হইল, এক আল্লাহর পরিবর্তে মূর্তিপূজা ও নক্ষত্র পূজায় নিমগ্ন হইল, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁহার বান্দাদিগকে সুপথে আনিবার জন্য ইবরাহীম (আ)-কে নবীরূপে প্রেরণ করিবার ইচ্ছা করিলেন। এমতাবস্থায় জ্যোতিষী ও গণকগণ তৎকালীন পরাক্রমশালী বাদশাহ নমরূদের নিকট গিয়া বলিল, আমরা আমাদের বিদ্যার মাধ্যমে দেখিতে পাইতেছি যে, আপনার এই অঞ্চলে অমুক বৎসরের অমুক মাসে ইবরাহীম নামে এক শিশু জন্মগ্রহণ করিবে। সে আপনার ধর্ম ধ্বংস করিয়া ফেলিবে এবং মূর্তি ভাঙ্গিয়া ফেলিবে। আপনার রাজত্বের বিলুপ্তিও তাহার দ্বারাই হইবে। কোন কোন বর্ণনায় আছে, তাহারা বলিয়াছিল যে, ইহা তাহারা পূর্ববর্তী নবীদের গ্রন্থে পাইয়াছে (ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৭; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২০; ইবনুল-জাওযী, আল-মুনতাজাম, ১খ, ২৫৯)। অতঃপর গণকদের বর্ণনাকৃত সেই বৎসরের সেই মাস শুরু হইলে নমরূদ তাহার এলাকার প্রত্যেক গর্ভবতী মহিলার নিকট একজন লোক প্রেরণ করিল। সে উক্ত মহিলার প্রতি নজর রাখিতে লাগিল। অতঃপর যখনই কোন মহিলা কোন পুত্রসন্তান প্রসব করিত তখনই নমরূদের নির্দেশে তাহাকে হত্যা করা হইত। কিন্তু আযরের স্ত্রী, ইবরাহীম (আ)-এর মাতার ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন। তিনি অল্প বয়স্কা থাকায় তাঁহাকে দেখিয়া গর্ভবতী বলিয়া মনে হইত না। তাই নমরূদের মোতায়েনকৃত লোক কেহই তাহার গর্ভ আঁচ করিতে পারে নাই। ইবরাহীম (আ)-এর মাতা যখন প্রসব বেদনা অনুভব করিলেন তখন নিকটস্থ পর্বত গুহায় চলিয়া গেলেন। সেখানে ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করিলেন। অতঃপর প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সমাপন করত গুহার মুখ বন্ধ করিয়া তিনি বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। ইহার পর তিনি গুহায় গিয়া তাঁহাকে দেখিয়া আসিতেন। তিনি যখনই যাইতেন দেখিতেন যে, ইবরাহীম জীবিত আছেন এবং স্বীয় বৃদ্ধাঙ্গুলী চোষণ করিতেছেন। আল্লাহ তাআলা এই চোষণের মাধ্যমেই তাঁহার রিযিক দিয়াছিলেন (আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ১১৯-১২০; আল-মুনতাজাম, ১খ, ২৫৯)। আবু রুয়ক বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম (আ)-এর মাতা যখনই আসিতেন তখনই তাঁহাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী চুষিতে দেখিতেন। একদিন তিনি বলিলেন, তাঁহার অঙ্গুলীতে কি আছে তাহা অবশ্যই আমি দেখিব। অতঃপর তিনি দেখিতে পাইলেন যে, ইবরাহীম (আ) এক অঙ্গুলী দিয়া পানি, এক অঙ্গুলী দিয়া দুধ, এক অঙ্গুলী দিয়া মধু, এক অঙ্গুলী দিয়া খেজুর এবং এক অঙ্গুলী দিয়া ঘি চোষণ করিতেছেন (ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৮)। আর তাহার স্ত্রীকে গর্ভ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিয়াছিলেন, আমি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করিয়াছিলাম, সে মৃত্যুবরণ করিয়াছে। আর ইহা শুনিয়া বিশ্বাস করিলেন এবং চুপ হইয়া গেলেন। ইবরাহীম (আ) সেখানে বড় হইতে লাগিলেন। খুব দ্রুত তিনি বড় হইয়া উঠেন। তাঁহার বয়বৃদ্ধির সময়-কালকে আল্লাহ তাআলা বরকতময় করিয়া দেন। তাই তাঁহার একদিন ছিল এক মাসের ন্যায় (মতান্তরে এক সপ্তাহের ন্যায়), এক মাস ছিল এক বৎসরের ন্যায়। তিনি উক্ত পর্বত গুহায় মোট ১৫ মাস ছিলেন। এক দিন তিনি তাঁহার মাতাকে বলিলেন, আমাকে বাহির করিয়া লইয়া চলুন, আমি বাহিরের দৃশ্য দেখিব। অতঃপর মাতা তাঁহাকে রাত্রিবেলায় বাহির করিয়া লইয়া আসেন। এই বর্ণনামতে ইবরাহীম (আ) তাঁহার পিতাকে জানান যে, তিনি তাহার পুত্র। তাঁহার মাতাও আযরকে জানান যে, ইবরাহীম তাহার পুত্র। ইহার পর সমস্ত ঘটনা তাহাকে অবহিত করেন। ইহাতে আযর অত্যন্ত আনন্দিত হন (আত-তাবারী, ১খ, ১২০)। উপরিউক্ত বর্ণনা হইতে বুঝা যায় যে, গুহা হইতে বাহির হইবার সময় ইবরাহীম (আ)- যুবা বয়সে উপনীত হন। কারণ এক মাস এক বৎসরের সমান হইলে ১৫ মাস অর্থাৎ ১৫ বৎসর। ছালাবীও এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন যে, গুহায় থাকিতেই ইবরাহীম (আ) যুবকে পরিণত হন (ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৮)।

তাহার জন্ম সম্পর্কে সুদ্দী ইবন মাসউদ (রা) ও অন্যান্য সাহাবী সূত্রে ভিন্ন বর্ণনা দিয়াছেন। তাহা হইল : নমরূদ একদিন স্বপ্ন দেখিল যে, একটি তারকা উদিত হইয়াছে। উহা চন্দ্র ও সূর্যের আলোকে স্তিমিত করিয়া দিয়াছে, এমনকি উহাদের আর একটুও আলো নাই। ইহাতে নমরূদ দারুণভাবে ঘাবড়াইয়া গেল। সে যাদুকর, গণক, জ্যোতিষী প্রমুখকে ডাকিয়া ইহার অর্থ জিজ্ঞাসা করিল। তাহারা বলিল, আপনার রাজত্বে এক শিশু জন্মগ্রহণ করিবে, যাহার হাতে আপনার ও আপনার রাজত্বের ধ্বংস অনিবার্য (ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৭)। নমরূদের বাসস্থান ছিল বাবিল শহরে। অতঃপর সে সেখান হইতে বাহির হইয়া অন্য এলাকায় চলিয়া গেল এবং মহিলাদিগকে রাখিয়া সকল পুরুষকে বাহির করিয়া লইয়া আসিল, যাহাতে উক্ত শিশু কোন মহিলার গর্ভে আসিতে না পারে। অতঃপর সে নির্দেশ দিল যে, কোন পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করিলেই যেন তাহাকে হত্যা করা হয়। এইভাবে নমরূদ তাহাদের বহু পুত্রসন্তান হত্যা করিয়া ফেলিল। অতঃপর শহরে তাহার কোন একটি প্রয়োজন দেখা দিল। সে ইবরাহীম (আ)-এর পিতা আয়রকে ছাড়া আর কাহাকেও বিশ্বাস করিতে পারিল না। তাহাকে ডাকাইয়া আনিয়া কাজ বুঝাইয়া দিল এবং বলিল : দেখিও, তোমার স্ত্রীর সহিত মেলামেশা করিও না। আর তাহাকে বলিল, আমি আমার দীনকে উহা হইতে বেশী গুরুত্ব দিই। আর যখন এলাকায় গিয়া উক্ত কাজ সমাপন করিল তখন তাহার মনে হইল, পরিবারের কি অবস্থা একটু দেখিয়া যাই না! অতঃপর স্ত্রীকে দেখিয়া নিজকে আর বশে রাখিতে পারিল না। তাহার সহিত মেলামেশা করিল। অতঃপর স্ত্রীকে লইয়া সে বর্তমান কূফা ও বসরার মধ্যবর্তী উর নামক স্থানে চলিয়া গেল। সেখানে একটি গর্তে সে স্ত্রীকে লুকাইয়া রাখিল। সেখানেই সে স্ত্রীর খানাপিনা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়া আসিত। এদিকে যখন অনেক দিন অতিবাহিত হইল তখন বাদশাহ বলিল, গণকদের কথা মিথ্যা। তোমারা তোমাদের স্ব স্ব গৃহে ফিরিয়া যাও। তখন তাহারা ফিরিয়া আসিল। ওদিকে সেই গুহায় ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করিলেন। প্রতিদিন তাহার এক সপ্তাহ, প্রতি সপ্তাহ এক মাস, প্রতি মাস এক বৎসরের মত অতিবাহিত হইতে লাগিল। বাদশাহ তাহা ভুলিয়া গেল। ইবরাহীম (আ) বড় হইয়া উঠিলেন। তিনি তাঁহার পিতামাতা ছাড়া অন্য কোন সৃষ্টি দেখেন নাই। ইবরাহীমের পিতা তাহার সঙ্গী-সাথীদিগকে বলিল, আমার একটি পুত্র আছে যাহাকে আমি লুকাইয়া রাখিয়াছি। তাহাকে যদি আমি লইয়া আসি তাহা হইলে কি বাদশাহের ভয় আছে : তাহারা বলিল, না, তাহাকে লইয়া আস। তিনি গিয়া তাহাকে গুহা হইতে বাহিরে লইয়া আসিল (আত-তাবারী, তারীখ, ১৩, ১২০-১২১; আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৭-৭৮; ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৭৩)।

ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত আছে যে, ইবরাহীম (আ)-এর মাতা যখন গর্ভবতী হইলেন তখন গণকগণ নমরূদকে বলিল, যে শিশু পুত্রের সংবাদ আমরা আপনাকে দিয়াছিলাম সে অদ্য রাত্রে মায়ের গর্ভে আসিয়াছে। তখন নমরূদ পরবর্তীতে ভূমিষ্ট সকল শিশুপুত্রকে হত্যার নির্দেশ দিল। অতঃপর ইবরাহীম (আ)-এর মাতার যখন সন্তান প্রসবের সময় ঘনাইয়া আসিল এবং প্রসব বেদনা আরম্ভ হইল তখন এই ভয়ে তিনি বাড়ি হইতে পলায়ন করিলেন যে, জানাজানি হইয়া গেলে তাহার সন্তানকে হত্যা করা হইবে। অতঃপর শুষ্ক একটি ঝর্ণার নিকট আসিয়া তিনি সন্তান প্রসব করিলেন। সন্তানকে একটি বস্ত্রখণ্ডে আচ্ছাদিত করিয়া একটি গর্তে রাখিলেন। অতঃপর ফিরিয়া আসিয়া স্বামীকে তিনি একটি পুত্রসন্তান প্রসবের কথা জানাইলেন এবং তাহাকে কোথায় রাখিয়া আসিয়াছেন তাহাও জানাইলেন। অতঃপর তাহার পিতা আসিয়া তাহাকে উক্ত স্থান হইতে লইয়া গিয়া শুষ্ক ঝর্ণার নিকট একটি গর্ত খুঁড়িয়া তাহার মধ্যে রাখিল এবং হিংস্র জন্তুর ভয়ে উহার মুখ পাথর দ্বারা বন্ধ করিয়া দিল। তাঁহার মাতা বিভিন্ন সময়ে আসিয়া তাহাকে দুধ পান করাইয়া যাইতেন (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৭)।

বংশ লতিকা

তাওরাত-এর বর্ণনামতে তাঁহার বংশলতিকা হইল : ইবরাহীম ইবন তারাহ (বয়স ২৫০ বৎসর) ইব্‌ন নাহ্র (বয়স ১৪৮ বৎসর) ইব্‌ন নূহ আলায়হিস সালাম (Genesis, 11: 10-27; ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৩৯; আত-তাবারী, তারীখ, ১২, ১১৯)। তাঁহার বংশ লতিকার ছক নিম্নরূপঃ

সাম এর জন্মের সময় তাহার পিতা নূহ (আ)-এর বয়স ৫০০ বৎসর

আরফাখশা-এর “ “ “ “ সাম “ “ ১০০ “

শালিহ “ “ “ “ আরফাখশায় “ “ ১২৫ “

আবির “ “ “ “ শালিহ “ “ ৩০ “

ফালিজ “ “ “ “ আবির “ “ ৩৪ “

রাউ “ “ “ “ ফালিজ “ “ ৩০ “

সারূজ “ “ “ “ রাউ “ “ ৩২ “

নাহূর “ “ “ “ সারূজ “ “ ৩০ “

তারাহ “ “ “ “ নাহূর “ “ ২৯ “

আবরাম/ইবরাহীম “ “ “ “ তারাহ “ “ ৭৫ “

মোট-৯৮৫ বৎসর।

(আল-নাজজার, কাসাসুল-আম্বিয়া,পৃ. ৭৩)।

ইতিহাস ও বাইবেলে ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম তারাহ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। কিন্তু কুরআন কারীমে তাহাকে আর বলা হইয়াছে। ইরশাদ হইয়াছে; }}uT! J6, zi is। “স্মরণ কর, ইবরাহীম তাহার পিতা আষরকে বলিয়াছিল, আপনি কি মূর্তিকে ইলাহরূপে গ্রহণ করেন?” (৬ : ৭৪)? তাই উলামায়ে কিরাম এই অসামঞ্জস্য দূরীকরণে বিভিন্ন প্রকারের ব্যাখ্যা পেশ করিয়াছেন।

(১) কাহারও মতে তারাহ ও আযর একই ব্যক্তি। তারাহ তাহার নামবাচক বিশেষ্য ( Le) আর আযর গুণবাচক বিশেষ্য (s; Le)। ইহাদের মতে আযর হিব্রু শব্দ যাহার অর্থ মূর্তি প্রেমিক, তারাহ মূর্তির সহিত সর্বদাই জড়িত ছিল। সে মূর্তি তৈরি করিত এবং মূর্তির পূজাও করিত। এইজন্য তাহাকে আযর উপাধি দেওয়া হয় এবং এই উপাধিতেই সে প্রসিদ্ধি লাভ করে। আর কিছু লোকের ধারণা, আযর শব্দের অর্থ » অর্থাৎ নির্বোধ বা বেওকুফ ও অকেজো বৃদ্ধ (আয-যাবীদী, তাজুল-আরূস, ৩খ, ১১)। তারাহ-এর মধ্যে এই বিশেষণ বর্তমান ছিল বিধায় এই গুণবাচক বিশেষ্যের দ্বারাই সে পরিচিত হইয়া যায়। তাই কুরআন কারীমে তাহার উক্ত প্রসিদ্ধ গুণবাচক বিশেষ্য তথা উপাধিতেই উল্লেখ করা হইয়াছে। আল্লামা সুহায়লী তাঁহার রাওদুল উনুফ গ্রন্থে এই মত বর্ণনা করিয়াছেন (১খ, ৭৪)।

(২) কাহারও কাহারও মতে উক্ত আয়াতে ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম উল্লেখ নাই। এখানে আয়াতের অর্থ সেই মূর্তি যাহা তাহার পিতা তৈরি করিত এবং যাহার সে পূজাও করিত। এই মর্মে মুজাহিদ (র) হইতে একটি রিওয়ায়াত রহিয়াছে যে, কুরআন কারীমের উল্লিখিত আয়াতের অর্থ হইল । অর্থাৎ ali Ci তুমি কি আরকে উপাস্য বলিয়া মান্য কর, অর্থাৎ মূর্তিকে উপাস্য মান? আল্লামা সানআনীর ধারণাও ইহাই। মোটকথা ইহাদের মতে কুরআন কারীমে ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম উল্লেখ করা হয় নাই। আল্লামা আবদুল ওয়াহহাব নাজজার-এর রায় হইল, মুজাহিদ (র)-এর মতটিই যুক্তিযুক্ত এবং গ্রহণযোগ্য। কারণ মিসরের প্রাচীন দেবতাদের মধ্যে একটির নাম ছিল আয়ুরীস, যাহার অর্থ “শক্তিশালী ও সাহায্যকারী খোদা”। আর মূর্তি পূজারীদের মধ্যে পূর্ব হইতেই এই প্রথা প্রচলিত ছিল যে, তাহারা প্রাচীন দেবতাদের নামে লূতন দেবতাদের নামকরণ করিত। তাই এই মূর্তিটির নামও প্রাচীন মিসরীয় দেবতার নাম অনুসারে আর রাখা হয়। আর উহারই কথা কুরআন কারীমে উল্লিখিত হইয়াছে (হিফজুর রাহমান সিউহারবী, কাসাসুল-কুরআন, ১৩, ১৫২-১৫৩)।

(৩) একটি প্রসিদ্ধ বর্ণনামতে ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম তারাহ আর চাচার নাম আযর। চাচাই তাহাকে পুত্রস্নেহে লালন-পালন করে। তাই কুরআন কারীমে তাহাকে ইবরাহীম (আ)-এর পিতা বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। চাচা তো পিতার সমপর্যায়ের। রাসূলুল্লাহ (স)-এর একটি হাদীছেও ইহার সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি ইরশাদ করিয়াছেন : “চাচা পিতার ন্যায়ই” (সিউহারবী, প্রাগুক্ত)।

তবে কুরআন কারীমের সুস্পষ্ট বর্ণনায় আয়রকে ইবরাহীম (আ)-এর পিতা বলা হইয়াছে। তাই অযথা উহার কোন রূপক অর্থ গ্রহণ বা অন্য কোনও জটিল বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলিয়া যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। যদি স্বীকারও করিয়া লওয়া হয় যে, আযর অর্থ মূর্তি প্রেমিক বা উহা দেবতার নাম, তবুও ইহার জটিল বিশ্লেষণে যাওয়ার প্রয়োজন নাই। উভয় অবস্থাতেই বলা যায় যে, আযর তাহার নামই ছিল। যেমন মূর্তিপূজারিগণ প্রাচীন কাল হইতেই নিজেদের সন্তানদিগের দেবতার গোলামসূচক নাম রাখিত (যথা আবদুল উযযা, আবদ মানাত প্রভৃতি), আর কখনো কখনো সরাসরি মূর্তির নামে নাম রাখিত। এই ক্ষেত্রেও তাহাই ঘটিয়া থাকিবে।

প্রকৃতপক্ষে কালদীয় ভাষায় বড় পূজারীকে বলা হয় আদার। আরবী ভাষায় ইহাকেই আর বলা হয় । ইবরাহীম (আ)-এর পিতা তারাহ যেহেতু মূর্তি নির্মাতা এবং সবচেয়ে বড় পূজারী ছিল, এইজন্য আযর নামেই সে প্রসিদ্ধি লাভ করে। অথচ ইহা তাহার নাম নহে, উপাধি। আর উপাধি যেহেতু নামের স্থান দখল করে সেহেতু কুরআন কারীমেও তাহাকে উক্ত নামেই উল্লেখ করা হইয়াছে (হিফজুর রাহমান সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন, ১খ, ১৫৩)।

নির্বোধ, বেওকুফ বা অকেজো বৃদ্ধ প্রভৃতি বিশেষণের কারণে আর বলা মোটেও সমর্থনযোগ্য নহে। কারণ হযরত ইবরাহীম (আ)-এর চরিত্র এতই উন্নত ছিল যে, পিতার সম্মুখে যখন তিনি মূর্তি পূজার অসারতা তুলিয়া ধরিলেন তখন পিতা রাগান্বিত হইয়া তাহাকে ভর্ৎসনা ও হুমকি প্রদর্শন করিয়া বলিয়াছিল :

“হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার দেব-দেবী হইতে বিমুখ? যদি তুমি নিবৃত্ত না হও তবে আমি প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণনাশ করিবই । তুমি চিরদিনের জন্য আমার নিকট হইতে দূর হইয়া যাও” (১৯ ও ৪৬)।

এত কর্কশ ভাষা ও কঠোর আচরণের পরও তিনি স্বীয় পিতার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভক্তি রাখিয়া বিনয়াবনতভাবে তাহার শান্তি কামনা করিয়াছিলেন এবং তাহার জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করার অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন :

“তোমার প্রতি সালাম । আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিব। নিশ্চয় তিনি আমার প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল” (১৯৪৭)।

সুতরাং এমন মহামানব হইতে স্বীয় পিতাকে নির্বোধ, বেওকুফ, অকেজো বৃদ্ধ প্রভৃতি অসম্মান সূচক বিশেষণে সম্বোধন করা বা তাহার সামনে উক্ত শব্দ ব্যবহার করা একেবারেই অসম্ভব (আবদুল ওয়াহহাব নাজজার, পৃ. ৭০)। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ইতিহাস ও বাইবেলে বর্ণিত তারাহ ও কুরআনে বর্ণিত আযর একই ব্যক্তি। আর তাহার নামবাচক বিশেষ্য । ); গুণবাচক বিশেষ্য (any Le) নহে। আর তারাই হয়ত-বা তাহার নাম নহে, আযর শব্দের অনুবাদ, ভুলক্রমে তারাহ নামটি উল্লিখিত হইয়াছে। আর তাওরাতের অন্যান্য অনূদিত নামের ন্যায় ইহা অনুবাদ না থাকিয়া বরং প্রকৃত নাম হইয়া গিয়াছে (সিউহারবী, কাসাসুল কুরআন, ১খ, ১৫৩-১৫৪)।

ইবরাহীম (আ)-এর পিতা আযর ছিল কাঠমিস্ত্রী। সে কাঠের মূর্তি তৈরি করিত এবং মূর্তি পুজকদের নিকট উহা বিক্রয় করিত (আন-নাজজার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৯)।

হাফিজ ইবন আসাকির ইসহাক ইবন বিশর আল-বাহিলী সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম (আ)-এর মাতার নাম ছিল উমায়লা। আল-কালবীর বর্ণনামতে তাহার নাম ছিল নূনা বিনত কারবানা ইব্‌ন কারছী। আস-সুহায়লী “লায়ূছা” বলিয়া তাহার আরো একটি নামের উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি ছিলেন আরফাখশায ইবন সাম ইবন নূহ (আ)-এর বংশধর (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৪০; ঐ লেখক, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ১১৯; আস-সুহায়লী, আর-রাদুল উনুফ, ১খ, ৭৫)।

তারাহ-এর বয়স যখন ৭৫ বৎসর তখন পুত্র ইবরাহীম (আ) জন্মগ্রহণ করেন। তারাহ-এর অপর দুই পুত্র ছিল নাহ্র ও হারান। হারান জ্যৈষ্ঠ, ইবরাহীম (আ) মধ্যম ও নাহ্র কনিষ্ঠ। হারানের পূত্র লূত (আ)। হারান তাহার পিতার জীবদ্দশায় স্বীয় জন্মভূমি কালদানীদের ভূমি অর্থাৎ বাৰিলে মারা যান। ইতিহাস ও সীরাতবিদগণের নিকট ইহাই প্রসিদ্ধ। হাফিজ ইবন আসাকির ইহাকেই সহীহ বলিয়াছেন (ইব্‌ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১৩, ১৪০; ঐ লেখক, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ১১৯; মুহাম্মদ আল-ফাকী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬১)।

আল-কুরআন কারীমে হযরত ইবরাহীম (আ)

কুরআন কারীমের বহু স্থানে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর আলোচনা করা হইয়াছে। তাহার হিদায়াত প্রাপ্তি, পিতা ও কওমের প্রতি তাওহীদের দাওয়াত এবং মূর্তির অসারতা প্রতিপাদন করিয়া যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান, জালিম ও জাহিল বাদশাহের সহিত বিতর্ক, তাঁহার অগ্নিপরীক্ষা, বার্ধক্যে সন্তান লাভ, সন্তান ও পরিবারবর্গের জন্য দুআ, ফেরেশতাদের সহিত কথোপকথন, কাবা গৃহ নির্মাণ ও হজ্জের ঘোষণা প্রদান প্রভৃতি বিষয়ে মাক্কী ও মাদানী উভয় প্রকার সূরাতেই তাঁহার ব্যাপক আলোচনা করা হইয়াছে। একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ সূরাও তাহার নামে নামকরণ করা হইয়াছে, যাহা মক্কায় অবতীর্ণ হয়। কুরআনুল কারীমের মোট ২৫টি সূরার ৬৯টি স্থানে তাহার নাম উল্লেখ করা হইয়াছে। তন্মধ্যে সূরা বাকারা, আল-ই ইমরান, আন-নিসা, আল-আনআম, হ্রদ, আন-নাহল, মারয়াম, আল-আম্বিয়া, আল-হাজ্জ ও আস-সাফফাত-এ বিস্তারিত আলোচনা করা হইয়াছে। যে সকল সূরা ও আয়াতে তাঁহার আলোচনা করা হইয়াছে তাহার একটি ছক নিম্নরূপঃ

ক্রমিক নং – সূরার নাম ও ক্রমিক নং – আয়াত সংখ্যা

১. আল-বাকারা-২ – ১২৪, ১২৫, ১২৬, ১২৭, ১৩০, ১৩২, ১৩৩, ১৩৫, ১৩৬, ১৪০, ২৫৮, ২৬০।

২. আল-ইমরান-৩ – ৩৩, ৬৫, ৬৭, ৬৮, ৮৪, ৯৫, ৯৭।

৩. আন-নিসা-৪ – ৫৪, ১২৫, ১৬৩।

৪. আল-আনআম-৬ – ৭৪, ৭৫, ৮৩, ১৬১।

৫. আত-তাওবা-৯ – ৭০, ১১৪।

৬. হূদ-১১ – ৬৯, ৭৪, ৭৫, ৭৬।

৭. ইউসুফ-১২ – ৬, ৩৮।

৮. ইবরাহীম-১৪ – ৩৫।

৯. আল-হিজর-১৫ – ৫১।

১০. আন-নাহল-১৬ – ১২০, ১২৩।

১১. মারয়াম-১৯ – ৪১, ৪৬, ৫৮।

১২. আল-আম্বিয়া-২১ – ৫১, ৬০, ৬২, ৬৯।

১৩. আল-হাজ্জ-২২ – ২৬, ৪৩, ৭৮।

১৪. আশ-শুআরা-২৬ – ৬৯।

১৫. আল-আনকাবূত-২৯ – ১৬, ৩১।

১৬. আল-আহযাব-৩৩ – ৭।

১৭. আল-সাফফাত-৩৭ – ৮৩, ১০৪, ১০৯।

১৮. সাদ-৩৮ – ৪৫।

১৯. আশ-শূরা-৪২ – ১৩।

২০. আয-যুখরুফ-৪৩ – ২৬।

২১. আয-যারিয়াত-৫১ – ২৪।

২২. আন-নাজম-৫৩ – ৩৭।

২৩. আল-হাদীস-৫৭ – ২৬।

২৪. আল-মুমতাহানা-৬০ – ৪।

২৫. আল-আলা-৮৭ – ১৯।

(আন-নাজজার, পৃ. ৭৭; সিঊহারবী, কাসাসুল কুরআন, ১খ, ১১৭-১৬৮)।

কুরআনুল কারীমে হযরত ইবরাহীম (আ) সম্পর্কে যে আলোচনা করা হইয়াছে উহার বিশদ বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল :

“এবং স্মরণ কর, যখন ইবরাহীমকে তাঁহার প্রতিপালক কয়েকটি কথা দ্বারা পরীক্ষা করিয়াছিলেন এবং সেইগুলি সে পূর্ণ করিয়াছিল। আল্লাহ বলিলেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করিতেছি। সে বলিল, আমার বংশধরগণের মধ্য হইতেও? আল্লাহ বলিলেন, আমার প্রতিশ্রুতি জালিমদের প্রতি প্রযোজ্য নহে। এবং সেই সময়কে স্মরণ কর যখন কাবাগৃহকে মানবজাতির মিলন কেন্দ্র ও নিরাপত্তা স্থল করিয়াছিলাম এবং বলিয়াছিলাম, তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর এবং ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে তাওয়াফকারী ইতিকাফকারী, রুকূ ও সিজদাকারীদের জন্য আমার গৃহকে পবিত্র রাখিবার আদেশ দিয়াছিলাম। স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম বলিয়াছিল, হে আমার প্রতিপালক! ইহাকে নিরাপদ শহর করিও। আর ইহার অধিবাসীদের মধ্যে যাহারা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান আনে তাহাদিগকে ফলমূল হইতে জীবিকা প্রদান করিও। তিনি বলিলেন, যে কেহ কুফরী করিবে তাহাকেও কিছু কালের জন্য জীবনোপভোগ করিতে দিব। অতঃপর তাহাকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করিতে বাধ্য করিব এবং কত নিকৃষ্ট তাহাদের প্রত্যাবর্তনস্থল! স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কাবাগৃহের প্রাচীর তুলিতেছিল তখন তাহারা বলিয়াছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এই কাজ গ্রহণ কর। নিশ্চয় তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার অনুগত কর এবং আমাদের বংশধর হইতে তোমার এক অনুগত উম্মত করিও। আমাদিগকে ইবাদতের নিয়ম-পদ্ধতি দেখাইয়া দাও এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হও। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের প্রতিপালক! তাহাদের মধ্য হইতে তাহাদের নিকট এক রাসূল প্রেরণ করিও যে তোমার আয়াতসমূহ তাহাদের নিকট তিলাওয়াত করিবে, তাহাদিগকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে এবং তাহাদিগকে পবিত্র করিবে। তুমি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। যে নিজকে নির্বোধ করিয়াছে সে বীতত ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ হইতে আর কে বিমুখ হইবে! পৃথিবীতে তাহাকে আমি মনোনীত করিয়াছি; আর আখিরাতেও সে অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণের অন্যতম। তাহার প্রতিপালক যখন তাহাকে বলিয়াছিলেন, আত্মসমর্পণ কর, সে বলিয়াছিল, জগৎসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করিলাম। এবং ইবরাহীম ও ইয়াকূব এই সম্বন্ধে তাহার পুত্রগণকে নির্দেশ দিয়া বলিয়াছিল, হে পুত্রগণ! আল্লাহই তোমাদের জন্য এই দীনকে মনোনীত করিয়াছেন। সুতরাং আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) না হইয়া তোমরা কখনও মৃত্যুবরণ করিও না। ইয়াকূবের নিকট যখন মৃত্যু আসিয়াছিল তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে? সে যখন পুত্রগণকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, আমার পরে তোমরা কিসের ইবাদত করিবে? তখন তাহারা বলিয়াছিল, আমরা আপনার ইলাহ-এর এবং আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাক-এর ইলাহ-এরই ইবাদত করিব। তিনি একমাত্র ইলাহ এবং আমরা তাঁহার নিকট আত্মসমর্পণকারী (২ : ১২৪-১৩৩)।

“তাহারা বলে, ইয়াহুদী বা খৃস্টান হও, ঠিক পথ পাইবে। বল, বরং একনিষ্ঠ হইয়া আমরা ইবরাহীমের মিল্লাত (ধর্মাদর্শ অনুসরণ করিব এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না” (২ ও ১৩৫-৬)।

“তোমরা কি বল, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাঁহার বংশধরগণ অবশ্যই ইয়াহূদী কিংবা খৃস্টান ছিল? বল, তোমরা কি বেশী জান, না আল্লাহ? আল্লাহর নিকট হইতে তাহার কাছে যে প্রমাণ আছে তাহা যে গোপন করে তাহার অপেক্ষা অধিকতর জালিম আর কে হইতে পারে? তোমরা যাহা কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে অনবহিত নহেন” (২: ১৪০)।

“তুমি কি ঐ ব্যক্তিকে দেখ নাই, যে ইবরাহীমের .. সহিত তাহার প্রতিপালক সম্বন্ধে বিতর্কে লিপ্ত হইয়াছিল, যেহেতু আল্লাহ তাহাকে কর্তৃত্ব দিয়াছিলেন। যখন ইবরাহীম বলিল, তিনি আমার প্রতিপালক যিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। সে বলিল, আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহীম বলিল, আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক হইতে উদয় করান, তুমি উহাকে পশ্চিম দিক হইতে উদয় করাও তো। অতঃপর যে কুফরী করিয়াছিল সে হতবুদ্ধি হইয়া গেল। আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না” (২৪ ২৫৮)।

“যখন ইবরাহীম বলিল, হে আমার প্রতিপালক! কিভাবে তুমি মৃতকে জীবিত কর আমাকে দেখাও। তিনি বলিলেন, তবে কি তুমি বিশ্বাস করনা? সে বলিল, কেন করিব না, তবে ইহা কেবল আমার চিত্ত প্রশান্তির জন্য। তিনি বলিলেন, তবে চারিটি পাখি লও এবং উহাদিগকে তোমার বশীভূত করিয়া লও। তৎপর তাহাদের এক এক অংশ এক এক পাহাড়ে স্থাপন কর। অতঃপর উহাদিগকে ডাক দাও। উহারা দ্রুত গতিতে তোমার নিকট আসিবে। জানিয়া রাখ যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়” (২. ২৬০)।

“নিশ্চয় আল্লাহ আদমকে, নূহকে ও ইবরাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরকে বিশ্বজগতে মনোনীত করিয়াছেন। ইহারা একে অপরের বংশধর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ” (৩ : ৩৩-৩৪)।

“হে কিতাবীগণ! ইবরাহীম সম্বন্ধে কেন তোমরা তর্ক কর, অথচ তাওরাত ও ইনজীল তো তাহার পরেই অবতীর্ণ হইয়াছিল? তোমরা কি বুঝ না? হাঁ, তোমরা তো সেইসব লোক, যে বিষয়ে তোমাদের সামান্য জ্ঞান আছে সে বিষয়ে তোমরাই তো তর্ক করিয়াছ, তবে যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞান নাই সে বিষয়ে কেন তর্ক করিতেছ? আল্লাহ জ্ঞাত আছেন এবং তোমরা জ্ঞাত নহ। ইবরাহীম ইয়াহুদীও ছিল না, খৃস্টানও ছিল না; সে ছিল একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণকারী এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্তও ছিল না। নিশ্চয় মানুষের মধ্যে তাহারা ইবরাহীমের ঘনিষ্ঠতম যাহারা তাহার অনুসরণ করিয়াছে এবং এই নবী ও যাহারা ঈমান আনিয়াছে, আর আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক” (৩ : ৬৫-৬৮)।

“বল, আমরা আল্লাহতে এবং আমাদের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছিল এবং যাহা মূসা, ঈসা ও অন্যান্য নবীগণকে তাহাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে প্রদান করা হইয়াছে তাহাতে ঈমান আনিয়াছি; আমরা তাহাদের মধ্যে কোন তারতম্য করি না এবং আমরা তাঁহারই নিকট আত্মসমর্পণকারী” (৩ : ৮৪)।

“বল, আল্লাহ সত্য বলিয়াছেন। সুতরাং তোমারা একনিষ্ঠ ইবরাহীমের (ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর, সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নহে” (৩ : ৯৫)।

“নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল তাহা তো বাক্কায়; উহা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। উহাতে (কাবা গৃহে) অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে, যেমন মাকামে ইবরাহীম। আর যে কেহ সেথায় প্রবেশ করে সে নিরাপদ” (৩ : ৯৬-৯৭)।

“অথবা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যাহা দিয়াছেন সেজন্য কি তাহারা তাহাদিগকে ঈর্ষা করে? আমি ইবরাহীমের বংশধরকেও তো কিতাব ও হিকমত প্রদান করিয়াছিলাম এবং তাহাদিগকে বিশাল রাজ্য দান করিয়াছিলাম।“ (৪:৫৪)

“তাহার অপেক্ষা দীনে কে উত্তম যে সৎকর্মপরায়ণ হইয়া আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং একনিষ্ঠভাবে ইবরাহীমের মিল্লাত (ধর্মাদর্শ অনুসরণ করে? আল্লাহ ইবরাহীমকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করিয়াছেন” (৪:১২৫)

“আমি তো তোমার নিকট ওহী প্রেরণ করিয়াছি, যেমন নূহ ও তাহার পরবর্তী নবীগণের নিকট ওহী প্রেরণ করিয়াছিলাম। ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণ, ঈসা, আইয়ূব, ইউনুস, হারূন ও সুলায়মানের নিকটও ওহী প্রেরণ করিয়াছিলাম এবং দাঊদকে যাকূর দিয়েছিলাম।“

“স্মরণ কর, ইবরাহীম তাহার পিতা আরকে বলিয়াছিল, আপনি কি মূর্তিকে ইলাহরূপে গ্রহণ করেন :আমি তো আপনাকে ও আপনার সম্প্রদায়কে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে দেখিতেছি। এইভাবে আমি ইবরাহীমকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর পরিচালন ব্যবস্থা দেখাই, যাহাতে সে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। অতঃপর রাত্রির অন্ধকার যখন তাহাকে আচ্ছন্ন করিল তখন সে নক্ষত্র দেখিয়া বলিল, ইহাই আমার প্রতিপালক। অতপর যখন উহা অস্তমিত হইল তখন সে বলিল, যাহা অস্তমিত হয় তাহা আমি পছন্দ করি না। অতঃপর যখন সে চন্দ্রকে সমুজ্জ্বলরূপে উদিত হইতে দেখিল তখন বলিল, ইহা আমার প্রতিপালক । যখন ইহাও আস্তমিত হইল তখন সে বলিল, আমাকে আমার প্রতিপালক সৎপথ প্রদর্শন না করিলে আমি অবশ্যই পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হইব। অতঃপর যখন সে সূর্যকে দীপ্তিমানরূপে উদিত হইতে দেখিল তখন বলিল, “ইহা আমার প্রতিপালক, ইহা সর্ববৃহৎ। যখন ইহাও অস্তমিত হইল তখন সে বলিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যাহাকে আল্লাহর শরীক কর তাহার সহিত আমার কোন সংশ্রব নাই। আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁহার দিকে মুখ ফিরাইতেছি যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নহি। তাহার সম্প্রদায় তাহার সহিত বিতর্কে লিপ্ত হইল। সে বলিল, তোমরা কি আল্লাহ সম্বন্ধে আমার সহিত বিতর্কে লিপ্ত হইবে? তিনি তো আমাকে সৎপথে পরিচালিত করিয়াছেন। আমার প্রতিপালক অন্যবিধ ইচ্ছা না করিলে তোমরা যাহাকে তাহার সহিত শরীক কর তাহাকে আমি ভয় করি না। সব কিছুই আমার প্রতিপালকের জ্ঞানায়, তবে কি তোমরা অনুধাবন করিবে না? তোমরা যাহাকে আল্লাহর শরীক কর আমি তাহাকে কিরূপে ভয় করিব? অথচ তোমরা আল্লাহর শরীক করিতে ভয় কর না, যে বিষয়ে তিনি তোমাদিগকে কোন সনদ দেন নাই। সুতরাং যদি তোমরা জান তবে বল, দুই দলের মধ্যে কোন দল নিরাপত্তা লাভের বেশী হকদার” (৬৭৪-৮১)?

“আর ইহা আমার যুক্তি-প্রমাণ যাহা ইবরাহীমকে দিয়াছিলাম তাহার সম্প্রদায়ের মুকাবিলায়; যাহাকে ইচ্ছা মর্যাদায় আমি উন্নীত করি। নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ । আর আমি তাহাকে দান করিয়াছিলাম ইসহাক ও ইয়াকুব, ইহাদের প্রত্যেককে সৎপথে পরিচালিত করিয়াছিলাম এবং তাহার বংশধর দাঊদ, সুলায়মান ও আইয়ুব, ইউসুফ, মূসা ও হারূনকেও; আর এইভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করি” (৬ : ৮৩-৮৪)।

“বল, আমার প্রতিপালক তো আমাকে সৎপথে পরিচালিত করিয়াছেন। উহাই সুপ্রতিষ্ঠিত দীন, ইবরাহীমের মিল্লাত (ধর্মাদর্শ); সে ছিল একনিষ্ঠ এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না” (৬ : ১৬১)।

“উহাদের পূর্ববর্তী নূহ, আদ ও ছামূদের সম্প্রদায়, ইবরাহীমের সম্প্রদায় এবং মাদয়ান ও বিধ্বস্ত নগরের অধিবাসিগণের সংবাদ কি উহাদের নিকট আসে নাই? উহাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসহ উহাদের রাসূলগণ আসিয়াছিল। আল্লাহ এমন নহেন যে, তাহাদের উপর জুলুম করেন, কিন্তু উহারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি জুলুম করে” (৯ : ৭০)।

“ইবরাহীম তাহার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছিল, তাহাকে ইহার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল বলিয়া। অতঃপর যখন ইহা তাহার নিকট সুস্পষ্ট হইল যে, সে আল্লাহর শত্রু, তখন ইবরাহীম উহার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করিল। ইবরাহীম তো কোমল হূদয় ও সহনশীল” (৯ : ১১৪)।

“আমার ফেরেশতাগণ তো সুসংবাদ লইয়া ইবরাহীমের নিকট আসিল। তাহারা বলিল, সালাম। সেও বলিল, ‘সালাম। সে অবিলম্বে এক কাবাবকৃত গো-বৎস লইয়া আসিল। সে যখন দেখিল, তাহাদের হস্ত উহার দিকে প্রসারিত হইতেছে না, তখন তাহাদিগকে অবাঞ্ছিত মনে করিল এবং তাহাদের সম্বন্ধে তাহার মনে ভীতির সঞ্চার হইল। তাহারা বলিল, ভয় করিও না, আমরা তো নূতের সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হইয়াছি। আর তাহার স্ত্রী দণ্ডায়মান এবং সে হাসিয়া ফেলিল। অতঃপর আমি তাহাকে ইসহাকের ও ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম। সে বলিল, কী আশ্চর্য! সন্তানের জননী হইব আমি, যখন আমি বৃদ্ধা এবং এই আমার স্বামী বৃদ্ধ! ইহা অবশ্যই এক অদ্ভুত ব্যাপার। তাহারা বলিল, আল্লাহর কাজে তুমি বিস্ময় বোধ করিতেছ? হে পরিবারবর্গ! তোমাদের প্রতি রহিয়াছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ। তিনি তো প্রশংসাহ ও সম্মানাহ্। অতঃপর যখন ইবরাহীমের ভীতি দূরীভূত হইল এবং তাহার নিকট সুসংবাদ আসিল তখন সে দূতের সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে আমার সহিত বাদানুবাদ করিতে লাগিল। ইবরাহীম তো অবশ্যই সহনশীল, কোমল হূদয়, সতত আল্লাহ অভিমুখী। হে ইবরাহীম! ইহা হইতে বিরত হও; তোমার প্রতিপালকের বিধান আসিয়া পড়িয়াছে; উহাদের প্রতি তো আসিবে শাস্তি যাহা অনিবার্য” (১১ : ৬৯-৭৬)।

“এইভাবে তোমার প্রতিপালক তোমাকে মনোনীত করিবেন এবং তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিবেন এবং তোমার প্রতি ও ইয়াকূবের পরিবার-পরিজনের প্রতি তাঁহার অনুগ্রহ পূর্ণ করিবেন, যেভাবে তিনি ইহা পূর্বে পূর্ণ করিয়াছিলেন তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের প্রতি। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়” (১২ : ৬)।

“আমি (ইউসুফ) আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের মতবাদ অনুসরণ করি । আল্লাহর সহিত কোন বস্তুকে শরীক করা আমাদের কাজ নহে। ইহা আমাদের ও সমস্ত মানুষের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ; কিন্তু অধিকাংশ মানুষই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না” (১২ : ৩৮)।

“স্মরণ কর, ইবরাহীম বলিয়াছিল, হে আমার প্রতিপালক! এই নগরীকে নিরাপদ করিও এবং আমাকে ও আমার পুত্রগণকে প্রতিমা পূজা হইতে দূরে রাখিও। হে আমার প্রতিপালক! এই সকল প্রতিমা তো বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করিয়াছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করিবে সেই আমার দলভুক্ত, কিন্তু কেহ আমার অবাধ্য হইলে তুমি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরদের কতককে বসবাস করাইলাম অনুর্বর উপত্যকায় তোমার পবিত্র গৃহের নিকট। হে আমাদের প্রতিপালক! এইজন্য যে, উহারা যেন সালাত কায়েম করে। অতএব তুমি কিছু লোকের অন্তর উহাদের প্রতি অনুরাগী করিয়া দাও এবং ফলাদি দ্বারা উহাদের রিযিকের ব্যবস্থা করিও, যাহাতে উহারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তো জান যাহা আমরা গোপন করি ও যাহা আমরা প্রকাশ করি। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কিছুই আল্লাহর নিকট গোপন থাকে না। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ই, যিনি আমাকে আমার বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করিয়াছেন। আমার প্রতিপালক অবশ্যই প্রার্থনা শুনিয়া থাকেন। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সালাত কায়েমকারী কর এবং আমার বংশধরদের মধ্য হইতেও। হে আমাদের প্রতিপালক! আমার প্রার্থনা কবুল কর। হে আমাদের প্রতিপালক! যেই দিন হিসাব অনুষ্ঠিত হইবে সেই দিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং মুমিনগণকে ক্ষমা করিও” (১৪ ও ৩৫-৪১)।

“আর উহাদিগকে বল ইবরাহীমের অতিথিদের কথা, যখন উহারা তাহার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল, সালাম, তখন সে বলিয়াছিল, আমরা তোমাদের আগমনে আতংকিত! উহারা বলিল, ভয় করিও না, আমরা তোমাকে এক জ্ঞানী পুত্রের শুভ সংবাদ দিতেছি। সে বলিল, তোমরা কি আমাকে শুভ সংবাদ দিতেছ আমি বার্ধক্যগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও? তোমরা কি বিষয়ে শুভ সংবাদ দিতেছ? উহারা বলিল, আমরা সত্য সংবাদ দিতেছি; সুতরাং তুমি হতাশ হইও না। সে বলিল, যাহারা পথভ্রষ্ট তাহারা ব্যতীত আর কে তাহার প্রতিপালকের অনুগ্রহ হইতে হতাশ হয় : সে বলিল, হে ফেরেশতাগণ! তোমাদের আর বিশেষ কি কাজ আছে : উহারা বলিল, আমাদিগকে এক অপরাধী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হইয়াছে, তবে পূতের পরিবারবর্গের বিরুদ্ধে নহে, আমরা অবশ্যই ইহাদের সকলকে রক্ষা করিব, কিন্তু তাহার স্ত্রীকে নহে। আমরা স্থির করিয়াছি যে, সে অবশ্যই পশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত” (১৫ : ৫১-৬০)।

“ইবরাহীম ছিল এক ‘উম্মাত, আল্লাহর অনুগত, একনিষ্ঠ এবং সে ছিল না মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত। সে ছিল আল্লাহর অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তাহাকে মনোনীত করিয়াছিলেন এবং তাহাকে পরিচালিত করিয়াছিলেন সরল পথে। আমি তাহাকে দুনিয়ায় দিয়াছিলাম এবং আখিরাতেও সে নিশ্চয়ই সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম। এখন আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করিলাম, তুমি একনিষ্ঠ ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না” (১৬ : ১২০-১২৩)।

“স্মরণ কর, এই কিতাবে উল্লিখিত ইবরাহীমের কথা; সে ছিল সত্যনিষ্ঠ, নবী। যখন সে তাহার পিতাকে বলিল, হে আমার পিতা! তুমি তাহার ইবাদত কর কেন যে শুনে না, দেখে না এবং তোমার কোন কাজেই আসে না? হে আমার পিতা! আমার নিকট তো আসিয়াছে জ্ঞান যাহা তোমার নিকট আসে নাই; সুতরাং আমার অনুসরণ কর, আমি তোমাকে সঠিক পথ দেখাইব। হে আমার পিতা! শয়তানের ইবাদত করিও না। শয়তান তো দয়াময়ের অবাধ্য। হে আমার পিতা! আমি তো আশংকা করি যে, তোমাকে দয়াময়ের শাস্তি স্পর্শ করিবে, তখন তুমি হইয়া পড়িবে শয়তানের বন্ধু । পিতা বলিল, হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার দেব-দেবী হইতে বিমুখ? যদি তুমি নিবৃত্ত না হও তবে আমি প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণনাশ করিবই; তুমি চিরদিনের জন্য আমার নিকট হইতে দূর হইয়া যাও। ইবরাহীম বলিল, তোমার প্রতি সালাম। আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিব, নিশ্চয় তিনি আমার প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল। আমি তোমাদিগের হইতে ও তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাহাদের ইবাদত কর তাহাদিগ হইতে পৃথক হইতেছি। আমি আমার প্রতিপালককে আহবান করি; আশা করি, আমার প্রতিপালককে আহবান করিয়া আমি ব্যর্থকাম হইব না। অতঃপর সে যখন তাহাদিগ হইতে ও তাহারা আল্লাহ ব্যতীত যাহাদের ইবাদত করিত সেই সকল হইতে পৃথক হইয়া গেল তখন আমি তাহাকে দান করিলাম ইসহাক ও ইয়াকূব এবং প্রত্যেককে নবী করিলাম। এবং তাহাদিগকে আমি দান করিলাম আমার অনুগ্রহ ও তাহাদের নাম-যশ সমুচ্চ করিলাম” (১৯ : ৪১-৫০)।

“আমি তো ইহার পূর্বে ইবরাহীমকে সৎপথের জ্ঞান দিয়াছিলাম এবং আমি তাহার সম্বন্ধে ছিলাম সম্যক পরিজ্ঞাত। যখন সে তাহার পিতা ও তাহার সম্প্রদায়কে বলিল, এই মূর্তিগুলি কী, যাহাদের পূজায় তোমরা রত রহিয়াছ? উহারা বলিল, আমরা আমাদের পিতৃপুরুষগণকে ইহাদের পূজা করিতে দেখিয়াছি। সে বলিল, তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের পিতৃপুরুষগণও রহিয়াছ সুস্পষ্ট ভ্রান্তিতে । উহারা বলিল, তুমি কি আমাদের নিকট সত্য আনিয়াছ; না তুমি কৌতুক করিতেছ? সে বলিল, না, তোমাদের প্রতিপালক তো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক, যিনি উহাদের সৃষ্টি করিয়াছেন এবং এই বিষয়ে আমি অন্যতম সাক্ষী। শপথ আল্লাহর! তোমরা চলিয়া গেলে আমি তোমাদের মূর্তিগুলি সম্বন্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা অবলম্বন করিব। অতঃপর সে চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া দিল মূর্তিগুলিকে, উহাদের প্রধানটি ব্যতীত; যাহাতে উহারা তাহার দিকে ফিরিয়া আসে। উহারা বলিল, আমাদের উপাস্যগুলির প্রতি এইরূপ করিল কে? সে নিশ্চয়ই সীমালংঘনকারী। কেহ কেহ বলিল, এক যুবককে উহাদের সমালোচনা করিতে শুনিয়াছি, তাহাকে বলা হয় ইবরাহীম। উহারা বলিল, তাহাকে উপস্থিত কর লোকসম্মুখে, যাহাতে উহারা সাক্ষ্য দিতে পারে। উহারা বলিল, হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যগুলির প্রতি এইরূপ করিয়াছ? সে বলিল, সেই তো ইহা করিয়াছে, এই তো ইহাদের প্রধান। ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা কর, যদি ইহারা কথা বলিতে পারে। তখন উহারা মনে মনে চিন্তা করিয়া দেখিল এবং একে অপরকে বলিতে লাগিল, তোমরাই তো সীমালংঘনকারী! অতঃপর উহাদের মস্তক অবনত হইয়া গেল এবং উহারা বলিল, তুমি তো জানই যে, ইহারা কথা বলে না। ইবরাহীম বলিল, তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর যাহা তোমাদের কোন উপকার করিতে পারে না, ক্ষতিও করিতে পারে না? ধিক তোমাদিগকে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাহাদের ইবাদত কর তাহাদিগকে! তবে কি তোমরা বুঝিবে না? উহারা বলিল, তাহাকে পোড়াইয়া দাও এবং সাহায্য কর তোমাদের দেবতাগুলিকে, তোমরা যদি কিছু করিতে চাই। আমি বলিলাম, হে অগ্নি! তুমি ইবরাহীমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হইয়া যাও। উহারা তাহার ক্ষতি সাধনের ইচ্ছা করিয়াছিল কিন্তু আমি উহাদিগকে করিয়া দিলাম সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। এবং আমি তাহাকে ও লূতকে উদ্ধার করিয়া লইয়া গেলাম সেই দেশে যেথায় আমি কল্যাণ রাখিয়াছি বিশ্ববাসীর জন্য। এবং আমি ইবরাহীমকে দান করিয়াছিলাম ইসহাক এবং পৌত্ররূপে ইয়াকূব; আর প্রত্যেককেই করিয়াছিলাম সৎকর্মপরায়ণ এবং তাহাদিগকে করিয়াছিলাম নেতা। তাহারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথ প্রদর্শন করিত; তাহাদিগকে ওহী প্রেরণ করিয়াছিলাম সঙ্কর্ম করিতে, সালাত কায়েম করিতে এবং যাকাত প্রদান করিতে; তাহারা আমারই ইবাদত করিত” (২১ : ৫১-৭৩)।

“এবং স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহীমের জন্য নির্ধারণ করিয়া দিয়াছিলাম সেই গৃহের স্থান, তখন বলিয়াছিলাম, আমার সহিত কোন শরীক করিও না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখিও তাহাদের জন্য যাহারা তাওয়াফ করে এবং দাঁড়ায়, রুকু করে ও সিজদা করে। এবং মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা করিয়া দাও, উহারা তোমার নিকট আসিবে দূর-দূরান্ত পথ অতিক্রম করিয়া” (২২ : ২৬-২৭)।

“ইবরাহীম ও নূতের সম্প্রদায় এবং মাদয়ানবাসীরা (তাহাদের নবীগণকে অস্বীকার করিয়াছিল)। আর অস্বীকার করা হইয়াছিল মূসাকেও। আমি কাফিরদিগকে অবকাশ দিয়াছিলাম, অতঃপর তাহাদিগকে শাস্তি দিয়াছিলাম । অতএব কেমন ছিল শাস্তি” (২২ ও ৪৩-৪৪)।

“ইহা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাত। তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করিয়াছেন মুসলিম এবং এই কিতাবেও; যাহাতে রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হয় এবং তোমরা সাক্ষীস্বরূপ হও মানবজাতির জন্য” (২২ : ৭৮)।

“উহাদের নিকট ইবরাহীমের বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। সে যখন তাহার পিতা ও তাহার সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, তোমরা কিসের ইবাদত কর? উহারা বলিল, “আমরা মূর্তির পূজা করি এবং আমরা নিষ্ঠার সহিত উহাদের পূজায় নিরত থাকিব। সে বলিল, তোমরা প্রার্থনা করিলে উহারা কি শোনে অথবা উহারা কি তোমাদের উপকার কিংবা অপকার করিতে পারে? উহারা বলিল, না, তবে আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদিগকে এইরূপ করিতে দেখিয়াছি। সে বলিল, তোমরা কি ভাবিয়া দেখিয়াছ, কিসের পূজা করিতেছ, তোমরা এবং তোমাদের অতীত পিতৃপুরুষেরা? উহারা সকলেই আমার শত্রু, জগতসমূহের প্রতিপালক ব্যতীত; যিনি আমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনিই আমাদিগকে পথ প্রদর্শন করেন। তিনিই আমাকে দান করেন আহার্য ও পানীয় এবং রোগাক্রান্ত হইলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন; এবং তিনিই আমার মৃত্যু ঘটাইবেন, অতঃপর পুনর্জীবিত করিবেন এবং আশা করি, তিনি কিয়ামত দিবসে আমার অপরাধ মার্জনা করিয়া দিবেন। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জ্ঞান দান কর এবং সঙ্কর্মপরায়ণদের শামিল কর। আমাকে পরবর্তীদের মধ্যে যশস্বী কর এবং আমাকে সুখময় জান্নাতের অধিকারীদের অন্তর্ভুক্ত কর। আর আমার পিতাকে ক্ষমা কর, তিনি তো পথভ্রষ্টদের শামিল ছিলেন। এবং আমাকে লাঞ্ছিত করিও না পুনরুত্থান দিবসে, যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি কোন কাজে আসিবে না; সে দিন উপকৃত হইবে কেবল সে, যে আল্লাহর নিকট আসিবে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ লইয়া” (২৬ : ৬৯-৭৯)।

“স্মরণ কর ইবরাহীমের কথা, সে তাহার সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাহাকে ভয় কর; তোমাদের জন্য ইহাই শ্রেয় যদি তোমরা জানিতে! তোমরা তো আল্লাহ ব্যতীত কেবল মূর্তিপূজা করিতেছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করিতেছ। তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাহাদের পূজা কর তাহারা তোমাদের জীবনোপকরণের মালিক নহে। সুতরাং তোমরা জীবনোপকরণ কামনা কর আল্লাহর নিকট এবং তাহারই ইবাদত কর ও তাহার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তোমরা তাঁহারই নিকট প্রত্যাবর্তিত হইবে” (২৯ ও ১৬-১৭)।

“যখন আমার প্রেরিত ফেরেশতাগণ সুসংবাদসহ ইবরাহীমের নিকট আসিল, তাহার বলিয়াছিল, আমরা এই জনপদবাসীদিগকে ধ্বংস করিব, ইহার অধিবাসীরা তো জালিম। ইবরাহী বলিল, এই জনপদে তো দূত রহিয়াছে। উহারা বলিল, সেথায় কাহারা আছে তাহা আমরা ভাল জানি, আমরা তো দূতকে ও তাহার পরিজনবর্গকে রক্ষা করিবই, তাহার স্ত্রীকে ব্যতীত; সে তো পাশ্চাতে অবস্থানকারীদের অন্তর্ভুক্ত” (২৯ ও ৩১-৩২)।

“স্মরণ কর, যখন আমি নবীদের নিকট হইতে অংগীকার গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং তোমার নিকট হইতেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মারইয়াম-তনয় ঈসার নিকট হইতেও। তাহাদের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিলাম দৃঢ় অংগীকার” (৩৩৭)।

“আর ইবরাহীম তো তাহার (নূহের) অনুগামীদের অন্তর্ভুক্ত। স্মরণ কর, সে তাহার প্রতিপালকের নিকট উপস্থিত হইয়াছিল বিশুদ্ধ চিত্তে। যখন সে তাহার পিতা ও তাহার সম্প্রদায়কে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, তোমরা কিসের পূজা করিতেছ; তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে অলীক ইলাহগুলিকে চাও? জগতসমূহের প্রতিপালক সম্বন্ধে তোমাদের ধারণা কি? অতঃপর সে তারকারাজির দিকে একবার তাকাইল এবং বলিল, আমি অসুস্থ। অতঃপর উহারা তাহাকে পশ্চাতে রাখিয়া চলিয়া গেল । পরে সে সন্তর্পণে উহাদের দেবতাগুলির নিকট গেল এবং বলিল, তোমরা খাদ্য গ্রহণ করিতেছ না কেন? তোমাদের কী হইয়াছে যে, তোমরা কথা বল না? অতঃপর সে উহাদের উপর সবলে আঘাত হানিল। তখন ঐ লোকগুলি তাহার দিকে ছুটিয়া আসিল। সে বলিল, তোমরা নিজেরা যাহাদিগকে খোদাই করিয়া নির্মাণ কর তোমরা কি তাহাদেরই পূজা কর? প্রকৃতপক্ষে আল্লাহই সৃষ্টি করিয়াছেন তোমাদিগকে এবং তোমরা যাহা তৈরী কর তাহাও। উহারা বলিল, ইহার জন্য এক ইমারত নির্মাণ কর, অতঃপর ইহাকে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ কর। উহারা তাহার বিরুদ্ধে চক্রান্তের সংকল্প করিয়াছিল; কিন্তু আমি উহাদিগকে অতিশয় হেয় করিয়া দিলাম। সে বলিল, আমি আমার প্রতিপালকের দিকে চলিলাম। তিনি আমাকে অবশ্যই সৎপথে পরিচালিত করিবেন। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান কর। অতঃপর আমি তাহাকে এক স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তাহার পিতার সঙ্গে কাজ করিবার মত বয়সে উপনীত হইল তখন ইবরাহীম বলিল, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবাহ করিতেছি, এখন তোমার অভিমত কি বল? সে বলিল, হে আমার পিতা! আপনি যাহা আদিষ্ট হইয়াছেন, তাহাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাইবেন। যখন তাহারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করিল এবং ইবরাহীম তাহার পুত্রকে কাত করিয়া শায়িত করিল, তখন আমি তাহাকে আহবান করিয়া বলিলাম, হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নদেশ সত্যই পালন করিলে! এইভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করিয়া থাকি। নিশ্চয়ই ইহা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাহাকে মুক্ত করিলাম এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে। আমি ইহা পরবর্তীদের স্মরণে রাখিয়াছি । ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হউক। এইভাবে আমি সৎকর্মপরায়ণদিগকে পুরস্কৃত করিয়া থাকি। সে ছিল আমার মুমিন বান্দাদের অন্যতম। আমি তাহাকে সুসংবাদ দিয়াছিলাম ইসহাকের। সে ছিল এক নবী, সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম। আমি তাহাকে বরকত দান করিয়াছিলাম এবং ইসহাককেও; তাহাদের বংশধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মপরায়ণ এবং কতক নিজেদের প্রতি স্পষ্ট অত্যাচারী” (৩৭ : ৮৩-১১৩)।

“স্মরণ কর আমার বান্দা ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূবের কথা। উহারা ছিল শক্তিশালী ও সূক্ষ্মদর্শী। আমি তাহাদিগকে অধিকারী করিয়াছিলাম এক বিশেষ গুণের, উহা ছিল পরলোকের স্মরণ। অবশ্যই তাহারা ছিল আমার মনোনীত উত্তম বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত” (৩৮ : ৪৫-৪৭)।

“তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করিয়াছেন দীন যাহার নির্দেশ দিয়াছিলেন তিনি নূহকে আর যাহার আমি ওহী করিয়াছি তোমাদের এবং যাহার নির্দেশ দিয়াছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলিয়া যে, তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠা কর এবং উহাতে মতভেদ করিও না” (৪২ ও ১৩)।

“স্মরণ কর, ইবরাহীম তাহার পিতা ও সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, তোমরা যাহাদের পূজা কর তাহাদের সহিত আমার কোন সম্পর্ক নাই; সম্পর্ক আছে শুধু তাঁহারই সহিত, যিনি আমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং তিনিই আমাকে সৎপথে পরিচালিত করিবেন। এই ঘোষণাকে সে স্থায়ী বাণীরূপে রাখিয়া গিয়াছে তাহার পরবর্তীদের জন্য, যাহাতে উহারা প্রত্যাবর্তন করে” (৪৩ : ২৬-২৮)।

“তোমার নিকট ইবরাহীমের বৃত্তান্ত আসিয়াছে কি? যখন উহারা তাহার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল, ‘সালাম। উত্তরে সে বলিল, “সালাম। ইহারা তো অপরিচিত লোক। অতঃপর ইবরাহীম তাহার স্ত্রীর নিকট গেল এবং একটি মাংসল গো-বৎস ভাজা লইয়া আসিল ও তাহাদের সামনে রাখিল এবং বলিল, তোমরা খাইতেছ না কেন? ইহাতে উহাদের সম্পর্কে তাহার মনে ভীতির সঞ্চার হইল। উহারা বলিল, ভীত হইও না। অতঃপর উহারা তাহাকে এক জ্ঞানী পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিল। তখন তাহার স্ত্রী চিৎকার করিতে করিতে সম্মুখে আসিল এবং গাল চাপড়াইয়া বলিল, এই বৃদ্ধা-বন্ধ্যার সন্তান হইবে। তাহারা বলিল, তোমার প্রতিপালক এইরূপ বলিয়াছেন; তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। ইবরাহীম বলিল, হে ফেরেশতাগণ! তোমাদের বিশেষ কাজ কি? উহারা বলিল, আমাদিগকে এক অপরাধী সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরণ করা হইয়াছে, উহাদের উপর নিক্ষেপ করিবার জন্য মাটির শক্ত ঢেলা, যাহা সীমালংঘনকারীদের জন্য চিহ্নিত তোমার প্রতিপালকের নিকট হইতে” (৫১ : ২৪-৩৪)।

“এবং (তাহাকে কি অবগত করানো হয় নাই যাহা আছে) ইবরাহীমের কিতাবে, যে পালন করিয়াছিল তাহার দায়িত্ব? উহা এই যে, কোন বহনকারী অপরের বোঝা বহন করিবে না” (৫৩: ৩৭-৩৮)।

“আমি নূহ ও ইবরাহীমকে রাসূলরূপে প্রেরণ করিয়াছিলাম এবং আমি তাহার বংশধরগণের জন্য স্থির করিয়াছিলাম নবুওয়াত ও কিতাব, কিন্তু উহাদের অল্পই সৎপথ অবলম্বন করিয়াছিল এবং অধিকাংশই ছিল সত্যত্যাগী” (৫৭ : ২৬)।

“তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তাহার অনুসারীদের মধ্যে রহিয়াছে উত্তম আদর্শ, যখন তাহারা তাহাদের সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল, তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাহার ইবাদত কর তাহার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই। আমরা তোমাদিগকে মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হইল শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য, যদি না তোমরা এক আল্লাহতে ঈমান আন। তবে ব্যতিক্রম তাহার পিতার প্রতি ইবরাহীমের উক্তি, আমি নিশ্চয়ই তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিব এবং তোমার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট আমি কোন অধিকার রাখি না। ইবরাহীম ও তাহার অনুসারিগণ বলিয়াছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদিগকে কাফিরদের পীড়নের পাত্র করিও না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদিগকে ক্ষমা কর; তুমি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়” (৬০ : ৪-৫)।

“ইহা তো আছে পূর্ববর্তী গ্রন্থে- ইবরাহীম ও মূসার গ্রন্থে” (৮৭ : ১৮-১৯)।

হাদীছে হযরত ইবরাহীম (আ)

“আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, কিয়ামতের দিন ইবরাহীম (আ) তাঁহার পিতা আযরের সাক্ষাত পাইবেন। আযরের চেহারা থাকিবে কালিমালিপ্ত ও ধূলিমলিন। ইবরাহীম তাহাকে বলিবেন, আমি তোমাকে বলিয়াছিলাম না যে, আমার অবাধ্য হইও না? তখন তাহার পিতা বলিবে, আজ আর তোমার অবাধ্য হইব না। তখন ইবরাহীম বলিবেন, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমার সহিত অঙ্গীকার করিয়াছিলেন যে, পুনরুত্থান দিবসে আমাকে অপদস্থ করিবেন না। আল্লাহর রহমত হইতে আমার পিতা দূরীভূত, ইহা হইতে বড় অপমান আমার জন্য আর কি হইতে পারে! তখন আল্লাহ তাআলা বলিবেন, আমি কাফিরদের উপর জান্নাত হারাম করিয়া দিয়াছি। অতঃপর তাহাকে বলা হইবে, হে ইবরাহীম! তোমার পায়ের নীচে কি? তিনি সেই দিকে তাকাইবেন। তাকাইয়া দেখিবেন নোংরা এক পুরুষ হায়েনা। অতঃপর উহার চার পা ধরিয়া উহাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হইবে” (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ৪ খ., ১৭৭-২৭৮, কিতাবুত তাফসীর, সূরা আল-আম্বিয়া)।

“ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (স) খুতবা দিতে গিয়া বলিলেন, তোমরা হাশরের ময়দানে উখিত হইবে নগ্নপদে, নগ্ন মস্তকে ও নগ্ন শরীরে। যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করিয়াছিলাম সেইভাবে পুনরায় সৃষ্টি করিব; প্রতিশ্রুতি পালন আমার কর্তব্য, আমি ইহা পালন করিবই । অতঃপর কিয়ামত দিবসে সর্বপ্রথম যাহাকে কাপড় পরানো হইবে তিনি ইবরাহীম (আ) (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, কিরমানীর ভাষ্যযুক্ত, ১৭খ., ২১৩; কিতাবুত তাফসীর, সূরাতুল আম্বিয়া)।

“সামুরা (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, গত রাত্রে (মিরাজের রাত্রে) আমার নিকট দুইজন আগন্তুক আসিল। অতঃপর আমরা লম্বা এক ব্যক্তির নিকট আসিলাম। সোজাসুজিভাবে আমি তাহার মস্তক দেখিতে পাইতেছিলাম না। তিনি ইবরাহীম আলায়হিস সালাম” (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ৪ খ, ২৭৯, হাদীছ নং ৩১৩৮)।

“মুজাহিদর হইতে বর্ণিত। তিনি এক মজলিসে ইবন আব্বাস (রা)-এর নিকট হইতে শুনিলেন যে, লোকজন তাহার নিকট দাজজালের আলোচনা প্রসঙ্গে বলিল যে, তাহার চক্ষুদ্বয়ের মধ্যখানে লিখিত থকিবে ৫ (কাফির) অথবা ১-৬-এ (কাফ, ফা, রা)। ইবন আব্বাস (রা) বলিলেন, আমি ইহা শুনি নাই। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছেন, আর ইবরাহীম (-এর আকৃতি জানিতে চাহ?) তবে তোমাদের সঙ্গীর (রাসূলুল্লাহ্র) প্রতি তাকাও” (বুখারী, আস-সাহীহ, ৪ খ, ২৭৯, হাদীছ নং ৩১৩৯; মুসলিম, আস-সাহীহ, ৭ খ., ৯৭)।

“আবু হুরায়রা (রা) হইতে। বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছেন : ইবরাহীম (আ) তিনটি ছাড়া কখনও (আপাত দৃষ্টিতে) মিথ্যা বলেন নাই। উহার দুইটি আল্লাহর জন্য। তিনি বলিয়াছিলেন, আমি অসুস্থ; আর বলিয়াছিলেন, বরং উহাদের এই বড়টি উহা করিয়াছে। আর একটি হইল, একদিন তিনি ও সারা এক স্বৈরাচারী জালিম বাদশাহর রাজ্যে উপস্থিত হইলেন। অতঃপর বাদশাহকে বলা হইল, অমুক স্থানে এক ব্যক্তি আসিয়াছে, তাহার সহিত এক মহিলা আছে যে পরমা সুন্দরী । অতঃপর বাদশাহ ইবরাহীম (আ)-এর নিকট লোক পাঠাইল। (তিনি আসার পর) বাদশাহ তাহাকে সারা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিল যে, এই মহিলা কে? ইবরাহীম (আ) বলিলেন, সে আমার ভগ্নী। অতঃপর তিনি সারার নিকট আসিয়া বলিলেন, সারা! এই ভূখণ্ডে আমি আর তুমি ছাড়া কোন মুমিন নাই। আর এই বাদশাহ আমাকে জিজ্ঞাসা করিলে, আমি তাহাকে জানাইয়াছি যে, তুমি আমার ভগ্নী। তাই আমাকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করিও না। অতঃপর বাদশাহ সারার নিকট লোক পাঠাইল। সারা যখন তাহার নিকট প্রবেশ করিলেন তখন সে হাত দিয়া তাহাকে ধরিতে গেলে তাহার হাত অবশ হইয়া গেল। অতঃপর সে বলিল, আল্লাহর কাছে আমার জন্য দুআ কর, আমি আর তোমার ক্ষতি করিব না। তিনি আল্লাহর নিকট দুআ করিলেন। তাহার হাত ঠিক হইয়া গেল। সে দ্বিতীয়বার পুনরায় তাঁহাকে ধরিতে গেল, তখন অনুরূপভাবে অথবা তাহার চেয়ে আরো শক্তভাবে তাহার হাত অবশ হইয়া গেল। সে বলিল, আল্লাহর কাছে আমার জন্য দুআ কর। আমি আর তোমার ক্ষতি করিব না। তিনি দুআ করিলেন। তাহার হাত ঠিক হইয়া গেল। তখন সে তাহার এক প্রহরীকে ডাকিয়া বলিল, তোমরা আমার নিকট কোন মানুষ আননি, আনিয়াছ এক শয়তান। অতঃপর হাজারকে তাহার খিদমত করিতে দিল। অতঃপর সারা ইবরাহীমের নিকট আসিলেন। তিনি তখন সালাতে দণ্ডায়মান ছিলেন। তাই হাত দিয়া ইশারায় তাহার সংবাদ জিজ্ঞাসা করিলেন। সারা বলিলেন, আল্লাহ কাফিরের অথবা বলিয়াছিলেন, পাপিষ্ঠের চক্রান্ত নস্যাঁত করিয়া দিয়াছেন এবং হাজারকে খিদমত করিতে দিয়াছে। আবু হুরায়রা (রা) বলেন, হে আরববাসী! তিনি হইলেন তোমাদের মাতা” (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ৪খ., ২৮০, হাদীছ নং ৩১৪৩; মুসলিম, আস-সাহীহ, ৭খ., ৯৮-৯৯)।

“উম্মু শুরায়ক (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) গিরগিটি হত্যা করার নির্দেশ দিয়াছেন । উহা ইবরাহীম (আ)-এর অগ্নিতে ফুঙ্কার দিয়াছিল” (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, ৪খ., ৫৯৮, কিতাবুখ আম্বিয়া)।

“ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বায়তুল্লাহ-এ প্রবেশ করিলেন এবং সেখানে ইবরাহীম (আ) ও মারয়াম (আ)-এর প্রতিকৃতি দেখিতে পাইলেন। তিনি বলিলেন, তাহাদের কি

অবস্থা! তাহারা তো শুনিয়াছে যে, যে গৃহে প্রতিকৃতি থাকে ফেরেশতাগণ সেখানে প্রবেশ করেন না। এই যে ইবরাহীমের প্রতিকৃতি, তিনি কখনও তীর দ্বারা ভাগ্য পরীক্ষা করেন নাই” (বুখারী, আস-সাহীহ, কিতাবুল আম্বিয়া, ৪খ. ৫৯৭)।

“ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) যখন বায়তুল্লাহ্-য় মূর্তি দেখিলেন তখন সেখানে প্রবেশ করিলেন না। তিনি সেইগুলি সরাইয়া ফেলিবার নির্দেশ দিলেন। অতঃপর উহা নিশ্চিহ্ন করিয়া দেওয়া হইল। তিনি ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আ)কে দেখিলেন যে, তাহাদের হাতে তীর। তিনি বলিলেন, আল্লাহ উহাদের (মুশরিকদের) ধ্বংস করুন। আল্লাহর কসম! এই দুইজন কখনো তীর দ্বারা ভাগ্য পরীক্ষা করেন নাই” (বুখারী, প্রাগুক্ত)

“আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত। একদিন রাসূলুল্লাহ (স)-এর নিকট গোশত আনা হইল। তিনি বলিলেন, আল্লাহ কিয়ামতের দিন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলকে এক ময়দানে একত্র করিবেন। অতঃপর ঘোষণাকারী তাহাদিগকে ঘোষণা শুনাইবে এবং সমস্ত ময়দান সমতল হওয়ার কারণে সকলের দৃষ্টিগোচর হইবে এবং সূর্য নিকটবর্তী হইবে। অতঃপর তাহারা ইবরাহীম (আ)–এর নিকট গিয়া বলিবে, আপনি দুনিয়াতে আল্লাহর নবী ও বন্ধু ছিলেন। আমাদের জন্য আপনার প্রতিপালকের নিকট সুপারিশ করুন। অতঃপর তিনি তাঁহার আপাত মিথ্যাগুলির কথা উল্লেখ করিয়া বলিবেন, ইয়া নাফসী! ইয়া নাফসী! তোমরা মূসার নিকট যাও” (বুখারী, আস-সাহীহ, কিতাবুল আম্বিয়া, ৪খ., ৫৯৯, হাদীছ নং-৩১৪৬)।

ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, ইবরাহীম (আ) আশি বৎসর বয়সে বাইস (কাম) দ্বারা খাতনা করেন অথবা কাদূম নামক স্থানে খতনা করেন” (বুখারী, আস-সাহীহ, কিতাবুল আম্বিয়া, ৪., ২৭৯, হাদীছ নং ৩১৪০; মুসলিম আস-সাহীহ, ৭খ, ৯৭)।

“ইব্‌ন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত। নবী (স) হাসান ও হুসায়নকে ঝাড়ফুঁক করিতেন এবং বলিতেন, তোমাদের (আদি) পিতা ইসমাঈল ও ইসহাককে এই বলিয়া ঝাড়ফুক করিতেন ।

“আমি আল্লাহর পূর্ণ শব্দাবলী দ্বারা শরণ লইতেছি সকল শয়তান হইতে এবং সকল ভীতিপ্রদ বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ হইতে এবং সকল ক্ষতিকর কুদৃষ্টি হইতে”।

“আবু যার (রা) মিরাজের হাদীছ বর্ণনা করিয়া বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন…. অতঃপর আমি ইবরাহীম (আ)-এর নিকট দিয়া গেলাম। তিনি বলিলেন, মারহাবা! পুণ্যবান নবী এবং পুণ্যবান বৎস! আমি বলিলাম, ইনি কে? জিবরীল বলিলেন, ইনি ইবরাহীম” (আল-বুখারী, আস-সাহীহ, বাউল খালক, হাদীছ নং ৪১২৭)।

“আনাস (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স)-এর জন্য উঁহুদ পর্বত উদ্ভাসিত হইল। অতঃপর তিনি বলিলেন, এই পর্বত আমাদিগকে ভালবাসে, আমরাও উহাকে ভালবাসি। হে আল্লাহ! ইবরাহীম মক্কা হারাম করিয়াছেন আর আমি উহার দুই কঙ্করময় মরুভূমির মধ্যখানে যাহা আছে তাহা হারাম করিতেছি” (আল-বুখারী, বাদউল-খালক, হাদীছ নং ৩১৫১)।

“উম্মুল মুমিনীন আইশা (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, তুমি কি দেখ নাই যে, তোমার সম্প্রদায় যখন কাবা নির্মাণ করে তখন তাহা ইবরাহীম-এর ভিত হইতে কমাইয়া দেয়? আমি বলিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি উহাকে ইবরাহীমের ভিত-এর উপর ফিরাইয়া দেন না কেন? তিনি বলিলেন, তোমার সম্প্রদায় যদি সদ্য কুফরী হইতে (ইসলামে) না আসিত (তবে আমি উহা করিতাম)” (আন-নাসাঈ, আস-সুনানুল-কুবরা, কিতাবুত-তাফসীর, ৬খ, ২৯০; আল-বুখারী, বাদউল-খালক, হাদীছ নং ৩১৫২)।

“কাব ইবন উজরা (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (স)-কে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাদের আহলে বায়ত-এর উপর কিভাবে সালাম পেশ করিতে হইবে? কারণ সালাম কিভাবে পেশ করিব তাহা তো আল্লাহ আমাদিগকে শিক্ষা দিয়াছেন। তিনি বলিলেন, তোমরা বলিও।

[ ]

(বুখারী, বাদউল খালক, হাদীছ নং ৩১৫৩)।

“ওয়াছিলা ইবনুল আসকা (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, আল্লাহ ইবরাহীমের বংশধরদের মধ্যে ইসমাঈলকে মনোনীত করেন, ইসমাঈলের বংশধরদের মধ্য হইতে বা কিনানাকে, বানূ কিনানার বংশধরদের মধ্য হইতে কুরায়শকে এবং কুরায়শদের মধ্য হইতে বা হাশিমকে এবং বানূ হাশিমের মধ্য হইতে আমাকে মনোনীত করেন” (তিরমিযী, আল-জামি আস-সাহীহ, ৫খ., ৫৮৩, কিতাবুল মানাকিব, হাদীছ নং ৩৬০৫)।

“যায়দ ইবন আরকাম (রা) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স)-এর সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই যবাহগুলি কিজন্য? তিনি বলিলেন, তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ)-এর সুন্নাত” (ইবন মাজা, ২৩, ২০৪, আবওয়াবুল-আদাহী)।

“আবু হুরায়রা (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, মুমিনদের শিশুরা জান্নাতবাসী হইবে। ইবরাহীম (আ) হইবেন তাহাদের তত্ত্বাবধায়ক” (আল-হাকেম আন-নায়সাবুরী, আল-মুসতাদরাক, ২৩, ৩৭০, কিতাবুত-তাফসীর)।

“ইবন আব্বাস (রা) হইতে বর্ণিত তিনি বলেন, ইবরাহীম (আ)-কে যখন অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয় তখন তাঁহার শেষ বাক্য ছিল LSI, II”আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক” । আর তোমাদের নবী অনুরূপ বলিয়াছেন, “যাহাদিগকে লোকে বলিয়াছিল, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জমায়েত হইয়াছে, সুতরাং তোমরা তাহাদিগকে ভয় কর। কিন্তু ইহা তাহাদের ঈমানকে দৃঢ়তর করিয়াছিল এবং তাহারা বলিয়াছিল, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক” (আল-হাকেম, আল-মুসতাদরাক, ২৩, ২৯৮, কিতাবুত-তাফসীর)।

জাবির (রা) হইতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, “ইবরাহীম খলীল (আ)-কে এই আরবী ভাষা ইলহাম করা হইয়াছিল” (প্রাগুক্ত, ২খ, ৩৪৪)।

ইবন আব্বাস (রা) বলেন, “ইসলামের ত্রিশটি অংশ। ইবরাহীম (আ)-এর পূর্বে আর কেহ উহা পূর্ণ করেন নাই। আল্লাহ তাআলা বলিয়াছেন,, s al, “ (৫৩: ৩৭)।

“এবং ইবরাহীমের কিতাবে, যে পালন করিয়াছিল তাহার দায়িত্ব” (প্রাগুক্ত, ২খ, ৪৭০)।

আনাস ইবন মালিক (রা) হইতে বর্ণিত। এক লোক রাসূলুল্লাহ (স)-এর নিকট আসিয়া বলিল, ইয়া খায়রাল-বারিয়্যা : (হে সৃষ্টির সর্বোত্তম ব্যক্তি)! রাসূলুল্লাহ (স) বলিলেন, “তাহা তো ইবরাহীম (আ)” (মুসলিম, আস-সাহীহ, খ, ৯৭, কিতাবুল-ফাদাইল)।

বাইবেলে হযরত ইবরাহীম (আ)

বাইবেলের আদিপুস্তকে ইবরাহীম (আ) সম্পর্কে যে বিবরণ পাওয়া যায় উহার সংক্ষিপ্তসার এই যে, সদাপ্রভু হযরত ইবরাহীম (আ)-কে নিজ আত্মীয়-স্বজন ও স্বদেশ ত্যাগ করিয়া কানআনে হিজরত করিতে বলেন এবং তাঁহাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি তাঁহার মাধ্যমে এক মহাজাতি উদগত করিবেন। যাহারা তাঁহার অনুসরণ করিবে তাহারা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হইবে এবং যাহারা তাহার অবাধ্যাচরণ হইবে তাহারা অভিশপ্ত হইবে। তদনুসারে তিনি পঁচাত্তর বৎসর বয়সে নিজ স্ত্রী সারা ও ভ্রাম্পুত্র লুত (আ)-কে সঙ্গে লইয়া নিজের পশপাল ও সম্পদরাজিসহ কানআনে হিজরত করেন। এখানে পৌঁছিবার পর সদাপ্রভু তাহাকে এই এলাকা দান করার প্রতিশ্রুতি দেন। পরে এই এলাকায় দুর্ভিক্ষ শুরু হইলে তিনি সস্ত্রীক মিসরে রওয়ানা হইলেন। সেখানে পৌঁছিবার পর সমসাময়িক মিসর-রাজ অসদুদ্দেশ্যে সারাকে অপহরণ করে। তাঁহার সহিত অসৎ আচরণ করিতে উদ্যত হইলে আল্লাহ তাআলা তাহার হস্তদ্বয় অবশ করিয়া দেন এবং সারা (রা) সসম্মানে ফিরিয়া আসেন। মিসর-রাজ ইবরাহীম (আ)-কে উপঢৌকনস্বরূপ অনেক ধন-সম্পদ দান করে এবং সারার সেবিকা হিসাবে হাজার (রা)-কে দান করে (দ্র. বাইবেলের আদিপুস্তক, ১২৪১-২০)। অনুরূপ আরও একটি ঘটনা বাইবেলে উক্ত হইয়াছে (দ্র. আদিপুস্তক, ২০ : ১-১৮)।

অতঃপর ইবরাহীম (আ) সারা ও লুত (আ)-কে রইয়া তথা হইতে পুনরায় কানআনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলেন। লূত (আ)-এরও পর্যাপ্ত গবাদি পশু ও অন্যান্য সম্পদ ছিল। তাঁহাদের দুইজনের পশুসম্পদের প্রাচুর্যের কারণে একত্রে বসবাস অসম্ভব হইয়া পড়িলে ইবরাহীম (আ) ভ্রাতুস্পুত্রকে জর্দানে স্থানান্তরের পরামর্শ দিলে তিনি তথায় স্থানান্তরিত হইলেন এবং ইবরাহীম (আ) কানআনে থাকিয়া গেলেন (দ্র, আদিপুস্তক, ১৩ ও ১৮; আরও দ্রত নিবন্ধ)।

ইবরাহীম (আ) তাঁহার নিঃসন্তান অবস্থার কথা উল্লেখ করিলে আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে সন্তানদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং আরও বলিলেন যে, তাঁহার অধস্তন বংশধর প্রায় চারি শত বৎসর বিদেশীদের অধীনস্ত থাকিবে। অবশেষে তাহারা প্রচুর সহায়-সম্পদসহ এই অবস্থা হইতে মুক্তি পাইবে। সদাপ্রভু তাঁহার বংশধরকে মিসর হইতে ফোরাত নদী পর্যন্ত বিশাল ভূভাগ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন (আদিপুস্তক, ১৬ ও ১-২১)। এখানে তাঁহাকে যেই সন্তান দানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছিল তিনি হইলেন হযরত ইসমাঈল (আ)। কারণ আদিপুস্তকে পরবর্তী অধ্যায়ে ইসমাঈল (আ)-এর জন্ম ও তাঁহার বৃত্তান্ত বর্ণনা করা হইয়াছে।

ইসমাঈল (আ)-এর জন্ম : সারা (রা) নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁহার সেবিকা হাজার (রা)-কে স্বউদ্যোগে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সহিত বিবাহ দিলেন এবং তাঁহার গর্ভে হযরত ইসমাঈল (আ) জন্মগ্রহণ করেন। সতীনের সহিত মনোমালিন্যের কারণে একদা হাজার (রা) গৃহ হইতে পলায়ন করেন। পথিমধ্যে সদাপ্রভুর দূত তাহার সহিত সাক্ষাত করিয়া তাহাকে বাড়ি ফিরিয়া যাইতে ও সারার অনুগত হইয়া থাকিতে বলেন। তিনি তাহাকে আরও সুসংবাদ দিলেন যে, তাঁহার গর্ভ হইতে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করিবে এবং তাহার পর্যাপ্ত বংশবৃদ্ধি ঘটিবে । ইবরাহীম (আ)-এর ছিয়াশি বৎসর বয়সে ইসমাঈল (আ) জন্মগ্রহণ করেন (আদিপুস্তক, ১৬ ও ১-১৬)।

ত্বকচ্ছেদের নিয়ম স্থাপন ও সদাপ্রভু ইবরাহীম (আ)-কে দর্শন দিয়া তাঁহার আব্রাম (মহাপিতা) নাম পরিবর্তন করিয়া আব্রাহাম (বহু লোকের পিতা) রাখিলেন এবং ইহার কারণ স্বরূপ বলিলেন যে, তিনি বহু জাতির পিতা হইবেন। সদাপ্রভু এই পর্যায়ে তাঁহাকে লিঙ্গাগ্রের ত্বকচ্ছেদের স্থায়ী নির্দেশ দান করেন। তখন তাঁহার বয়স নিরানব্বই বৎসর এবং ইসমাঈল (আ)-এর বয়স তের বৎসর। নির্দেশ অনুসারে তিনি তাঁহার ও তাঁহার পোষ্যবর্গের লিঙ্গাগ্রের ত্বকচ্ছেদ করেন। এই পর্যায়ে সদাপ্রভু তাঁহাকে সারার গর্ভে আরও একজন পুত্রসন্তান লাভের সুসংবাদ দান করেন, অপরদিকে ইসমাঈল (আ)-এর বংশে প্রতাপশালী বারোজন শাসকের আবির্ভাব হইবারও সুসংবাদ দিলেন (দ্র. আদিপুস্তক, ১৭ ও ১-২৭)।

লুত (আ)-এর কওমের জন্য ইবরাহীম (আ)-এর প্রার্থনা : মস্লির এলোন বনের নিকটে অপরিচিত মানববেশে তিনজন ফেরেশতা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সহিত সাক্ষাত করিলেন। তিনি তাহাদের জন্য যথাসাধ্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করিলেন। আহার শেষে তাহারা তাহাকে ইসহাক (আ)-এর জন্মলাভের এবং তাঁহার হইতে এক মহাজাতির আবির্ভাবের সুসংহ্লাদ দিলেন, অতঃপর লূত (আ)-এর কওমের ধ্বংসের দুঃসংবাদ জানাইলেন ( আদিপুস্তক, ১৮ ও ১-২২)। বাইবেলে এই ঘটনার বর্ণনা কুরআন মজীদের বর্ণনার প্রায় অনুরূপ (দ্র. ১৫ : ৫১-৫৯; ৫১ : ২৪-৩৩)।

ইসহাক (আ)-এর জন্ম ও ইসমাঈল (আ)-এর নির্বাসন ও ইবরাহীম (আ)-এর একশত বৎসর বয়সে ইসহাক (আ) জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি পুত্রের আট দিন বয়সে তাহার লিঙ্গাগ্রের ত্বকেচ্ছেদ করিলেন। দুই স্ত্রীর মধ্যকার মনোমালিন্যের কারণে এবং প্রথমা স্ত্রীর দাবিতে ইবরাহীম (আ) হাজার (রা)-কে শিশুপুত্র ইসমাঈল (আ)-সহ সংগে কিছু রুটি ও পানি দিয়া বাড়ি হইতে বিদায় করিয়া দিলেন। তিনি শিশুপুত্রসহ বের শেবা প্রান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। এদিকে পানীয় ফুরাইয়া গেলে তিনি শিশু পুত্রের জীবন নাশের আশংকা করিলেন এবং তাহাকে এক স্থানে শোয়াইয়া রাখিয়া দূরে বসিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। এই অসহায় মুহূর্তে আল্লাহর দূত আগমন করিয়া তাঁহাকে অভয় দিলেন এবং তাহার জন্য পানির একটি ঝর্ণা প্রবাহিত করিলেন। বালকটি বড় হইয়া ধনুর্দ্ধর হইল এবং পারণ প্রান্তরে বসতি বসতি স্থাপন করিল (দ্র. আদিপুস্তক, ২১ : ১-২১; বিস্তারিত দ্র. শিরো. ইসমাঈল (আ))।

ইবরাহীম (আ)-এর মহাপরীক্ষা ও এই সকল ঘটনার পর সদাপ্রভু ইবরাহীম (আ)-এর পরীক্ষা নিলেন। তিনি তাঁহাকে পুত্র ইসহাক (আ)-কে মোরিয়া দেশে লইয়া গিয়া সেখানে তাহাকে কুরবানী করার নির্দেশ দিলেন। তদনুযায়ী তিনি দুইজন দাসসহ ইসহাক (আ)-কে লইয়া নির্দিষ্ট স্থানে গমন করিলেন। সেখানে পৌঁছিয়া তিনি কোরবানগাহ নির্মাণ করিয়া পুত্রের হস্ত-পদ বাঁধিয়া খড়গহস্তে তাহাকে কুরবানী করিতে উদ্যত হইলে আকাশ হইতে সদাপ্রভুর দূত তাহাকে ডাকিয়া কহিলেন, ইসহাকের প্রতি তোমার হস্ত বিস্তার করিও না। কারণ তুমি সদাপ্রভুকে ভয় কর এবং নিজের অদ্বিতীয় পুত্রকেও দিতে অসম্মত নাও। ইবরাহীম (আ) পশ্চাৎদিকে তাকাইয়া কোপেরদ্ধ একটি মে দেখিতে পাইলেন এবং তিনি উহাকে কুরবানী করিলেন। ইহার পর সদাপ্রভু তাঁহার পর্যাপ্ত বংশবৃদ্ধির এবং তাঁহাদেরকে পৃথিবীতে অনুগ্রহ প্রাপ্ত ও প্রভাব-প্রতিপত্তি করিবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। পরে ইবরাহীম (আ) সপরিবারে বের-শেবাতে বসতি স্থাপন করেন (দ্র. আদিপুস্তক, ২২ : ১-১৯; ইসমাঈল (আ) শীর্ষক নিবন্ধে বিস্তারিত দ্র.)।

ইবরাহীম (আ)-এর বিবাহ ও মৃত্যু ও পরবর্তী পর্যায়ে ইবরাহীম (আ) কটুরা নাম্নী এক মহিলাকে বিবাহ করেন। তাঁহার গর্ভে সিন, যকষন, মদান, মিদিয়ন, যিশবক ও শূহ জন্মগ্রহণ করেন। ইবরাহীম (আ) আপন সর্বস্ব ইসহাক (আ)-কে দান করেন এবং অপরাপর স্ত্রীর সন্তানদিগকে বিভিন্ন দান দিয়া নিজ জীবদ্দশায় পূর্বদেশে প্রেরণ করেন। অতঃপর ইবরাহীম (আ) একশত পঁচাত্তর বৎসর কয়সে ইনতিকাল করেন। পুত্র ইসমাঈল ও ইসহাক (আ) তাঁহাকে মন্ত্রির সম্মুখে হেতীয় সোহরের পুত্র ইফ্রোনের ক্ষেত্রস্থিত মপলা গুহাতে দাফন করেন। স্ত্রী সারার কবরও এখানেই। ভূমিটির ক্রয় সূত্রে মালিক ছিলেন ইবরাহীম (আ) (দৃ. আদিপুস্তক, ২৫ : ১-১৮)। দাওয়াত ও তাবলীগ

হযরত ইবরাহীম (আ) কখন নবুওয়াত প্রাপ্ত হন তাহার সঠিক সময় জানা না গেলেও আল-কুরআনুল কারীমের বিবরণ হইতে প্রতীয়মান হয় যে, বাল্যকাল হইতেই আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে সঠিক জ্ঞান ও হিদায়াত দান করিয়াছিলেন। ইরশাদ হইয়াছে :

“ আমি তো ইহার পূর্বে ইবরাহীমকে সৎপথের জ্ঞান দিয়াছিলাম এবং আমি তাহার সম্বন্ধে ছিলাম সম্যক পরিজ্ঞাত” (২১ : ৫১)।

সীরাত ও ইতিহাসবিদগণ কর্তৃক বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা হইতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, বাল্যকাল হইতেই তিনি ছিলেন সত্যানুসন্ধানী। ইমাম ছালাবী বর্ণনা করিয়াছেন যে, গুহার মধ্যে থাকিয়া ইবরাহীম (আ) যখন যুবক হইলেন তখন একদিন তাহার মাতাকে বলিলেন, আমার প্রতিপালক কে? মাতা বলিল, আমি । তিনি বলিলেন, আপনার প্রতিপালক কে? মাতা বলিল, তোমার পিতা। তিনি বলিলেন, আমার পিতার প্রতিপালক কে? মাতা বলিল, নমরূদ। তিনি বলিলেন, নমরূদের প্রতিপালক কে? তখন মাতা তাহাকে এক ধমক দিয়া বলিল, চুপ কর। তখন ইবরাহীম (আ) চূপ করিয়া গেলেন। অতঃপর তাঁহার মাতা স্বামীর নিকট ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আমাদের লূতন বালক, যে তোমার পুত্র, আমি দেখিতেছি যে, সে জগত্বাসীর দীন পরিবর্তন করিয়া ফেলিতেছে। অতঃপর ইবরাহীম (আ) যাহা যাহা বলিয়াছিলেন তাহা স্বামীকে শুনাইল। ইবরাহীম (আ) তাঁহার পিতাকে অনুরূপ প্রশ্ন করিয়াছিলেন। তাঁহার পিতা মায়ের অনুরূপ জবাব দিয়াছিলেন। নমরূদের প্রতিপালক কে? এই প্রশ্নের জবাবে পিতা তাহাকে একটি চপেটাঘাত করিয়া বলিল, চুপ কর (আছ-ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৭৮)।

ইবরাহীম (আ) যুবক অবস্থায় একদিন পিতার সহিত (এক বর্ণনামতে মাতার সহিত) গুহা হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। তখন সূর্য অস্ত গিয়াছে। তিনি চতুষ্পদ জন্তু ও অন্যান্য সৃষ্টি দেখিয়া কৌতূহলবশত সেইগুলি সম্পর্কে পিতাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। পিতাও তাহার প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগিলেন যে, এইটি উট, এইটি গাভী, ঐটি ঘোড়া, ঐটা বকরী প্রভৃতি। ইবরাহীম (আ) বলিলেন, নিশ্চয়ই এইগুলির একজন প্রতিপালক আছেন যিনি তাহাদের সৃষ্টিকর্তা। অতঃপর তিনি আসমান-যমীনের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করিলেন এবং বলিলেন, যিনি আমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, রিযিক দিয়াছেন, আহার করাইয়াছেন, পান করাইয়াছেন, তিনিই ঠিক আমার প্রতিপালক। তিনি ভিন্ন আমার আর কোন ইলাহ (উপাস্য) নাই (ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৮-৭৯)। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মাথা তুলিলেন। সেখানে তিনি যুহরাঃ (শুক্র) মতান্তরে মুশতারী (বৃহস্পতি) নক্ষত্র দেখিতে পাইয়া বলিলেন, এই আমার রব । কিছুক্ষণ পর তাহা অদৃশ্য হইয়া গেল। তাহা দেখিয়া তিনি বলিলেন, যাহা অস্ত যায় আমি তাহা পছন্দ করি না অর্থাৎ যে প্রতিপালক অদৃশ্য হয় তাহাকে আমি পছন্দ করি না। ইব্‌ন আব্বাস (রা)-এর বর্ণনামতে তিনি মাসের শেষদিকে বাহির হইয়াছিলেন তাই নক্ষত্রোদয়ের পূর্বে তখন চন্দ্র দেখিতে পান নাই। অতঃপর রজনীর মধ্য অথবা শেষভাগে তিনি সমুজ্জ্বল চন্দ্র উদিত হইতে দেখিলেন এবং বলিলেন, এই আমার প্রতিপালক। উহা যখন অদৃশ্য হইল তখন তিনি বলিলেন, আমাকে আমার প্রতিপালক সৎপথ প্রদর্শন না করিলে আমি অবশ্যই পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হইব। অতঃপর ভোর হইলে সূর্যকে দীপ্তিমানরূপে উদিত হইতে দেখিয়া তিনি বলিলেন, ইহা আমার প্রতিপালক, ইহা সর্ববৃহৎ। যখন তাহা অদৃশ্য হইল তখন আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে বলিলেন, “আত্মসমর্পণ কর”। তিনি বলিলেন, “জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করিলাম” (২ : ১৩১)।

অতঃপর তিনি তাহার কওমের নিকট আসিয়া তাহাদিগকে দাওয়াত দিয়া বলিলেন, “হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যাহাকে আল্লাহর শরীক কর তাহার সহিত আমার কোন সংশ্রব নাই। আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁহার দিকে মুখ ফিরাইতেছি যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নহি” (৬ ও ৭৬-৭৯; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২১)। ইবন কাছীর প্রমুখ এই মত প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন যে, ইবরাহীম (আ) গুহা হইতে বাহির হইয়াই এই সকল কথাবার্তা বলিয়াছিলেন। কারণ তখন তিনি ছোট ছিলেন। তাহারা ইহাকে ইসরাঈলী রিওয়াত বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন (দ্র, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৪৩)। তাহাদের মতে ইবরাহীম (আ) প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নক্ষত্র, চন্দ্র ও সূর্যকে প্রতিপালক বলিয়াছিলেন এবং তাহা অস্ত যাওয়ার পর ঐ সকল কথাবার্তা বলিয়াছিলেন। ইহার উদ্দেশ্য ছিল কওমের সামনে প্রশ্ন রাখা এবং তাহাদের বিবেক জাগ্রত করা। কাহারও কাহারও মতে সম্প্রদায়ের নিকট এই কথা প্রমাণ করার জন্য যে, যাহা পরিবর্তনশীল তাহা কখনও প্রতিপালক হওয়ার উপযুক্ত নহে। ইহাই অধিকাংশ ‘আলিমের মত যে, তিনি কওমকে হুশিয়ার করার জন্য অথবা তাহাদের সহিত বিদ্রূপ করার জন্য এইরূপ বলিয়াছিলেন (ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ.,৭৩)। তবে যেহেতু পূর্বেই ইমাম ছালাবীর বরাতে উল্লেখ করা হইয়াছে যে, আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-এর গুহার মধ্যে প্রতিপালিত হওয়ার সময়ের মধ্যে বরকত দেওয়ার ফলে তিনি দ্রুত বড় হইয়া উঠেন এবং যখন তিনি গুহার বাহিরে আসেন তখন যুবা বয়সে পদার্পণ করিয়াছিলেন, সেই হেতু ইমাম তাবারী বর্ণিত প্রথমোক্ত মতটি সঠিক হইতে পারে যে, গুহা হইতে বাহির হইয়া সত্যানুসন্ধানের জন্য তিনি ঐ সকল বাদানুবাদ করিয়াছিলেন। আর ইহাই আয়াতের (৬ ও ৭৬-৭৯) সহজ-সরল ব্যাখ্যা।

ইবরাহীম (আ)-এর পিতা আযর মূর্তি বানাইত। অতঃপর উহা সন্তানদিগকে বিক্রয় করিতে দিত। ইবরাহীম (আ) গুহা হইতে বাহিরে আসিবার পর সে তাহাকেও উহা বিক্রয় করিবার জন্য দিল। ইবরাহীম (আ) উহা লইয়া বাজারে গিয়া জোরে জোরে বলিতেন, “কে এমন জিনিস ক্রয় করিবে যাহা তাহার কোন ক্ষতিও করিবে না, উপকারও করিবে না”। তাঁহার ভ্রাতাগণ মূর্তি বিক্রয় করিয়া ফিরিয়া আসিত। কিন্তু তাঁহার মূর্তি সেইভাবেই পড়িয়া থাকিত, কেহই ক্রয় করিত না । অতঃপর তিনি উহা নদীতে লইয়া যাইতেন এবং তাঁহার কওম যে গোমরাহী ও মূর্খতায় ডুবিয়া ছিল তাহার প্রতি বিদ্রূপবশত উহাদের মস্তক পানিতে ডুবাইয়া বলিতেন, ‘পানি পান কর। আস্তে আস্তে তাঁহার মূর্তির প্রতি এই আচরণের কথা এবং তাহাদের সহিত এই বিদ্রুপের কথা ছড়াইয়া পড়িতে লাগিল (ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ.,৭৩; তাবারী, তারীখ, ১খ., ১২০)।

অতঃপর হযরত ইবরাহীম (আ) বিভিন্ন পন্থায় তাঁহার সত্যের প্রতি আহবান করার কাজ চালাইয়া যাইতে লাগিলেন। পিতাকে তিনি অত্যন্ত বিনীতভাবে বুঝাইলেন যে, তাঁহার নিকট সত্যের জ্ঞান আসিয়াছে যাহা দ্বারা তিনি জানিতে পরিয়াছেন যে, এই সকল মূর্তির পূজা করা শয়তানের ইবাদত, যাহার ফলে আল্লাহর শাস্তি অবধারিত। কিন্তু পিতা উহা ককূল করিল না, বরং উল্টা তাঁহার প্রাণনাশের হুমিক দিল । কিন্তু ইবরাহীম (আ) তাহার সহিত অত্যন্ত ন্ত্র ও মার্জিত আচরণ করেন, তাহার কল্যাণ কামনা করেন এবং আল্লাহর নিকট তাহার জন্য মাগফিরাত চাওয়ার অঙ্গীকার করেন। কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে :

“স্মরণ কর, এই কিতাবে উল্লিখিত ইবরাহীমের কথা; সে ছিল সত্যনিষ্ঠ নবী। যখন সে তাহার পিতাকে বলিল, হে আমার পিতা! তুমি তাহার ইবাদত কর কেন যে শুনে না, দেখে না এবং তোমার কোন কাজেই আসে না? হে আমার পিতা! আমার নিকট তো আসিয়াছে জ্ঞান যাহা তোমার নিকট আসে নাই; সুতরাং আমার অনুসরণ কর, আমি তোমাকে সঠিক পথ দেখাইব। হে আমার পিতা! শয়তানের ইবাদত করিও না। শয়তান তো দয়াময়ের অবাধ্য। হে আমার পিতা! আমি তো আশঙ্ক করি যে, তোমাকে দয়াময়ের শাস্তি স্পর্শ করিবে, তখন তুমি হইয়া পড়িবে শয়তানের বন্ধু। পিতা বলিল, হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার দেব-দেবী হইতে বিমুখ যদি তুমি নিবৃত্ত না হও তবে আমি প্রস্তরাঘাতে তোমার প্রাণ নাশ করিবই; তুমি চিরদিনের জন্য আমার নিকট হইতে দূর হইয়া যাও। ইবরাহীম বলিল, তোমার প্রতি সালাম। আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিব, নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল। আমি তোমাদের হইতে এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাহাদের ইবাদত কর তাহাদের হইতে পৃথক হইতেছি। আমি আমার প্রতিপালককে আহবান করি; আশা করি, আমার প্রতিপালককে আহবান করিয়া ব্যর্থকাম হইব না” (১৯ ৪১-৪৮)।

কওমকে দাওয়াত

তিনি তাঁহার সম্প্রদায়কে ও পিতাকে বুঝাইলেন যে, মূর্তি কখনো উপাস্য ও প্রতিপালক হইতে পারে না, বরং প্রতিপালক তো তিনি যিনি আসমান-যমীনের সৃষ্টিকর্তা। কুরআন শরীফে এই ব্যাপারে ইরশাদ হইয়াছে :

“তাহাদের নিকট ইবরাহীমের বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। সে যখন তাহার পিতা ও তাহার সম্প্রদায়কে বলিয়াছিল তোমরা কিসের ইবাদত কর? তাহারা বলিল, আমরা মূর্তির পূজা করি এবং আমরা নিষ্ঠার সহিত উহাদের পূজায় নিরত থাকিব। সে বলিল, তোমরা প্রার্থনা করিলে ইহারা কি শোনে? অথবা উহারা কি তোমাদের উপকার কিংবা অপকার করিতে পারে? তাহারা বলিল, না, তবে আমরা আমাদের পিতৃ-পুরুষদিগকে এইরূপই করিতে দেখিয়াছি। সে বলিল, তোমরা কি ভাবিয়া দেখিয়াছ কিসের পূজা করিতেছ, তোমরা এবং তোমাদের অতীত পিতৃপুরুষেরা? উহারা সকলেই আমার শত্রু, জগতসমূহের প্রতিপালক ব্যতীত; যিনি আমাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনিই আমাকে পথ প্রদর্শন করেন। তিনিই আমাকে দান করেন আহার্য ও পানীয় এবং রোগাক্রান্ত হইলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন এবং তিনিই আমার মৃত্যু ঘটাইবেন, অতঃপর পুনর্জীবিত করিবেন। এবং আশা করি তিনি কিয়ামত দিবসে আমার অপরাধ মার্জনা করিয়া দিবেন” (২৬ : ৬৯-৮২)।

সুদ্দী বর্ণনা করেন যে, প্রতি বৎসর তাহাদের একটি ঈদ হইত। তাহারা সকলেই সেখানে সমবেত হইত। সেই ঈদ হইতে যখন তাহারা প্রত্যাবর্তন করিত তখন মূর্তিগৃহে প্রবেশ করিয়া উহাকে সিজদা করিত। ইহার পর বাড়ি ফিরিত (ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮০)। ইবরাহীম (আ)-এর পিতা আযর তাহাকে বলিল, হে ইবরাহীম! আমাদের একটি ঈদ আছে। তুমি যদি আমাদের সঙ্গে সেখানে যাইতে তবে আমাদের দীন অবশ্যই তোমার ভাল লাগিত । অতঃপর ঈদের দিন তাহারা ঈদে গমন করিল। ইবরাহীম (আ) তাহাদের সহিত বাহির হইলেন। কিছু দূর গিয়া তাহার মনে কিছু একটা উদয় হইল। তিনি বলিলেন, আমি অসুস্থ। প্রকৃতপক্ষে তিনি তাহাদের দেবতাদিগকে অপদস্থ করত উহাদের অক্ষমতা ও অসারতা প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ করিতে এবং আল্লাহর প্রভুত্ব ও তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিলেন। আল্লাহর সত্য দীনকে সহায়তা কল্পেই তিনি এই কৌশল অবলম্বন করিয়াছিলেন। কুরআন শরীফে ইরশাদ হইয়াছে :

“অতঃপর সে তারকারাজির দিকে একবার তাকাইল এবং বলিল, আমি অসুস্থ। অতঃপর উহারা তাহাকে পশ্চাতে রাখিয়া চলিয়া গেল” (৩৭ : ৮৮-৯০)।

অতঃপর তিনি তাহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন :

“শপথ আল্লাহর, তোমরা চলিয়া গেলে আমি তোমাদের মূর্তিগুলি সম্বন্ধে অবশ্যই কৌশল অবলম্বন করিব” (২১ : ৫৭)।

তাহাদের মধ্যে দুর্বল এক ব্যক্তি পিছনে পড়িয়া গিয়াছিল, সে ইহা শুনিয়া ফেলিল। মুজাহিদ ও কাতাদার বর্ণনামতে, ইবরাহীম (আ) ইহা আস্তে আস্তে বলা সত্ত্বেও সে উহা শুনিয়া ফেলে এবং প্রচার করিয়া দেয়। অতঃপর ইবরাহীম (আ) দ্রুতপদে ও সন্তর্পণে তাহাদের দেবতা গৃহে আসিলেন। তিনি বিরাট এক মন্দিরে আসিলেন। মন্দিরের দরজায় বিরাটকায় একটি মূর্তি স্থাপিত ছিল। উহার পার্শ্বে ছিল আরো ছোট একটি, তাহার পার্শ্বে আরো ছোট একটি। এমনিভাবে প্রত্যেকটির পার্শ্বে ছিল তাহার চাইতে ছোট একটি মূর্তি। তাহার সম্প্রদায় বিভিন্ন রকমের খাবার তৈরি করিয়া তাহাদের দেবতাদের সম্মুখে ভোজ হিসাবে রাখিয়া দিয়াছিল এবং বলিয়াছিল, আমরা যখন প্রত্যাবর্তন করিব এবং ততক্ষণে আমাদের দেবতাগণ আমাদের খাবারে আশির্বাদ দিয়া দিবে তখন আমরা উহা খাইব। ইবরাহীম (আ) মন্দিরে প্রবেশ করিয়া যখন উহাদিগকে এবং উহাদের সম্মুখে রাখা খাবার দেখিলেন তখন বলিলেন, “তোমরা খাদ্য গ্রহণ করিতেছ না কেন” (৩৭ : ৯১)? উহারা যখন ইবরাহীম (আ)-এর কথার কোন উত্তর দিল না তখন তিনি ঠাট্টা ও বিদ্রুত করিয়া বলিলেন, “তোমাদের কী হইয়াছে যে, তোমরা কথা বল না”? অতপর তিনি উহাদের উপর সজোরে আঘাত হানিলেন” (৩৭ : ৯২-৯৩)। তিনি একখানি লোহার কুঠার লইয়া প্রতিটি মূর্তিকে ভাঙ্গিয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া ফেলিলেন। প্রধান মূর্তিটি ছাড়া আর একটিও অবশিষ্ট রহিল না। তখন কুঠারখানি উহার ঘাড়ে ঝুলাইয়া রাখিলেন যাহাতে তাহার সম্প্রদায় উহাকে দোষারোপ করে। ইহার পর তিনি বাহির হইয়া আসিলেন। ইহার প্রতিই ইঙ্গিত করা হইয়াছে কুরআন কারীমে ।

“অতপর সে চূর্ণ বিচূর্ণ করিয়া দিল মূর্তিগুলিকে উহাদের প্রধানটি ব্যতীত; যাহাতে উহারা তাহার দিকে ফিরিয়া আসে” (২১ ও ৫৮)।

প্রকৃতপক্ষে ইহা ছিল একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, তাহারা যদি কোন কিছু বুঝিতে পারিত তবে অবশ্যই যে তাহাদের প্রতি এইরূপ খারাপ আচরণ করিতে ইচ্ছা করে তাহাকে প্রতিহত করিতে পারিত। কিন্তু তাহাদের মূর্খতা, বুদ্ধির স্বল্পতা ও গোমরাহীর প্রচণ্ডতায় কোন শিক্ষাই গ্রহণ করিল না বরং ঈদ হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেবতা গৃহে প্রবেশ করিল এবং উহাদিগকে এই অবস্থায় দেখিয়া বলিল :

“আমাদের উপাস্যগুলির প্রতি এইরূপ করিল কে? সে নিশ্চয়ই সীমালংঘনকারী। কেহ কেহ বলিল, এক যুবককে উহাদের সমালোচনা করিতে শুনিয়াছি; তাহাকে বলা হয় ইবরাহীম” (২১ : ৫৯-৬০)।

তাহাকেই আমরা এই ব্যাপারে সন্দেহ করি । কেননা সে দেবতাদিগকে গালি দেয় ও সমালোচনা করে। এই সংবাদ যখন বাদশাহ নমরূদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নিকট পৌঁছিল তখন তাহারা বলিল, তাহাকে উপস্থিত কর তোক সম্মুখে, যাহাতে উহারা প্রত্যক্ষ করিতে পারে (২১ : ৬১) যে, সে-ই ইহা করিয়াছে। তাহারা বিনা প্রমাণে তাঁহাকে দোষারোপ করিতে অপছন্দ করিল। প্রকৃতপক্ষে ইবরাহীম (আ)-এর উদ্যেশ্য ইহাই ছিল যে, সকল লোক একত্র হউক। তাহা হইলে সকল মূর্তিপূজকের সম্মুখে তিনি প্রমাণ করিয়া দিবেন যে, তাহারা গোমরাহীর মধ্যে রহিয়াছে, যেমন মূসা (আ) ফিরআওনকে বলিয়াছিলেন :

“তোমাদের নির্ধারিত সময় উৎসবের দিন এবং যেই দিন পূর্বাহ্নে জনগণকে সমবেত করা হইবে” (২০ ও ৫৯)।

অতঃপর যখন তাঁহাকে আনা হইল তখন লোকজন বাদশাহ নমরূদের নিকট সমবেত হইল। তাহারা বলিল,

“হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যগুলির প্রতি এইরূপ করিয়াছ” (২১ : ৬২)? উত্তরে ইবরাহীম (আ) বলিলেন,

“বরং ইহাদের এই প্রধান, সেই তো ইহা করিয়াছে, ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা কর যদি ইহারা কথা বলিতে পারে” (২১ ও ৬৩)।

প্রকৃতপক্ষে ইহার উদ্দেশ্যে ছিল তাহাদের নিকট হইতে এই কথার স্বীকারোক্তি আদায় করা যে, ইহারা কথা বলিতে পারে না। এইগুলি জড় পদার্থ, অন্যান্য জড় পদার্থের ন্যায়ই। তখন তাহারা মূর্তি ভাঙ্গার জন্য তাহাকে যে দোষারোপ করিয়াছিল উহা হইতে ফিরিয়া আসিল এবং পরস্পর বলিতে লাগিল, আমরাই তাহার উপর জুলুম করিয়াছি; সে তো ঠিকই বলিয়াছে। যেমন ইরশাদ হইয়াছে ।

“তখন তাহারা মনে মনে চিন্তা করিয়া দেখিল এবং একে অপরকে বলিতে লাগিল, তোমরাই তো সীমালংঘনকারী” (২১ : ৬৪)।

ইহার পর তাহারা বুঝিতে পারিল এবং বলিল, উহারা তো কোন ক্ষতি করিতে পারে না, উপকার করিতে পারে না, কোন কিছু ধরিতেও পারে না। উহারা তো কথা বলিতে পারে না যে, কে এইরূপ করিয়াছে তাহা আমাদিগকে বলিয়া দিবে। হাত দিয়া ধরিতেও পারে না যে, আমরা তোমাকে সত্য বলিয়া সমর্থন করিব। কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে :

“অতঃপর উহাদের মস্তক অবনত হইয়া গেল এবং উহারা বলিল, তুমি তো জানই যে, ইহারা কথা বলে না” (২১ : ৬৫)।

অতঃপর তাহাদের উপর ইবরাহীম (আ)-এর যুক্তি প্রমাণ যখন অকাট্য বলিয়া বিবেচিত হইল এবং তাহারা পরাজয়ের গ্লানি লইয়া মাথা নোয়াইয়া ফেলিল তখন ইবরাহীম (আ) বলিলেন :

“তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর যাহা তোমাদের কোন উপকার করিতে পারে না, ক্ষতিও করিতে পারে না? ধিক তোমাদিগকে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাহাদের ইবাদত কর তাহাদিগকে! তবুও কি তোমরা বুঝিবে না” (২১ ও ৬৬-৬৭)?

তখন তাঁহার সম্প্রদায় আল্লাহর ব্যাপারে তাঁহার সহিত বিতর্ক করিতে প্রবৃত্ত হইল। তাহাদের দাবি ছিল, ইবরাহীম (আ) যাহার ইবাদত করেন তাহা হইতে তাহাদের উপাস্য ও দেবতারাই উত্তম। তখন ইবরাহীম (আ) উদাহরণ দিয়া তাহাদিগকে বুঝাইলেন যাহাতে তাহারা বুঝিতে পারে যে, তাহারা যাহার ইবাদত করে উহা অপেক্ষা আল্লাহই ইবাদত পাওয়ার বেশী যোগ্য এবং তাহাকেই ভয় করা উচিৎ। কুরআন কারীমে ইরশাদ হইয়াছে ।

“তাহার সম্প্রদায় তাহার সহিত বিতর্কে লিপ্ত হইল। সে বলিল, তোমরা কি আল্লাহ সম্বন্ধে আমার সহিত বিতর্কে লিপ্ত হইবে? তিনি তো আমাকে সৎপথে পরিচালিত করিয়াছেন। আমার প্রতিপালক অন্যবিধ ইচ্ছা না করিলে তোমরা যাহাকে তাহার শরীক কর তাহাকে আমি ভয় করি না। সব কিছুই আমার প্রতিপালকের জ্ঞানায়ত্ত, তবে কি তোমরা অনুধাবন করিবে না? তোমরা যাহাকে আল্লাহ্ শরীক কর আমি তাহাকে কিরূপে ভয় করিব? অথচ তোমরা আল্লাহর শরীক করিতে ভয় কর না, যে বিষয়ে তিনি তোমাদিগকে কোন সনদ দেন নাই। সুতরাং যদি তোমরা জান তবে বল, দুই দলের মধ্যে কোন্ দল নিরাপত্তা লাভের বেশী হকদার” (৬ ও ৮০-৮১)?

নমরূদের সহিত বিতর্ক

অতঃপর নমরূদ ইবরাহীম (আ)-কে বলিল, তুমি যে ইলাহের ইবাদত কর এবং যাহার ইবাদত করিতে অন্যকে দাওয়াত দাও, যাহার শক্তির কথা উল্লেখ কর এবং অন্যের উপর প্রাধান্য দাও তিনি কে? ইবরাহীম (আ) বলিলেন, তিনি আমার প্রতিপালক, যিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। নমরূদ বলিল, আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহীম বলিল, তুমি কিভাবে জীবন দান কর ও মৃত্যু ঘটাওঃ নমরূদ বলিল, আমি দুই ব্যক্তিকে ধরিয়া আনিব যাহাদিগকে আমার নির্দেশে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হইয়াছে। অতঃপর উহাদের একজনকে হত্যা করিব। এইভাবে আমি তাহার মৃত্যু ঘটাইলাম। আর অপরজনকে ক্ষমা করিয়া মুক্তি দিব। এইভাবে আমি তাহার জীবন দান করিলাম। তখন ইবরাহীম (আ) বলিলেন, “আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক হইতে উদয় করান, তুমি উহাকে পশ্চিম দিক হইতে উদয় করাও তো। তখন যে কুফরী করিয়াছিল সে (নমরূদ) হতবুদ্ধি হইয়া গেল” (২: ২৫৮)। সে বুঝিতে পারিল যে, ইহা তাহার দ্বারা সম্ভব নহে। দলীল-প্রমাণে সে পরাস্ত হইল (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২২-১২৩; ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৭৯)।

এইসব বাদানুবাদে ও দলীল-প্রমাণে পরাস্ত হইয়া নমরূদ ও তাহার সম্প্রদায় ইবরাহীম (আ)-এর উপর দারুণভাবে ক্ষিপ্ত হইল। তাহারা আলোচনা করিল যে, ইবরাহীমকে কাটিয়া টুকরা টুকরা

করিতে হইবে। কিন্তু তাহারা ভাবিয়া দেখিল যে, এই শাস্তি তো কিছুক্ষণের মধ্যে শেষ হইয়া যাইবে, তাহাতে তাহাদের অন্তরে ক্রোধের যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে উহা নিভিবে না। তাই তাঁহাকে এমন শাস্তি দিতে হইবে যাহা তিল তিল করিয়া তাহাকে দগ্ধীভূত করিবে। তাহারা সবশেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিল যে, তাঁহাকে অগ্নিতে দগ্ধিভূত করিয়া হত্যা করিতে হইবে। আর এমন অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করিতে হইবে যে, উহার উপর দিয়া উডডীয়মান পাখিও যেন পুড়িয়া যায় এবং যাহা ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হইয়া থাকে (মাহমূদ যাহরান, কাসাস মিনাল-কুরআন, পৃ. ৫৬)।

কুরআন কারীমে এই দিকেই ইঙ্গিত করা হইয়াছে :

“উহারা বলিল, তাহাকে পোড়াইয়া দাও এবং সাহায্য কর তোমাদের দেবতাগুলিকে, তোমরা যদি কিছু করিতে চাহ” (২১৪ ৬৮)।

মুজাহিদ বলেন, আমি একবার আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা)-এর সম্মুখে উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করিলাম। তখন তিনি বলিলেন, মুজাহিদ! তুমি কি জান কে সর্বপ্রথম ইবরাহীম (আ)-কে অগ্নিতে দগ্ধীভূত করার প্রস্তাব করিয়াছিল? আমি বলিলাম, না। তিনি বলিলেন, পারস্যের এক বেদুঈন। আমি বলিলাম, হে আবু আবদুর রাহমান! পারস্যে কি বেদুঈন আছে। তিনি বলিলেন, হ্যাঁ, কুদীরাই পারস্যের বেদুঈন। তাহাদেরই এক ব্যক্তি ইবরাহীম (আ)-কে আগুনে দগ্ধীভূত করিবার প্রস্তাব করিয়াছিল (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৩)। ইব্‌ন জুরায়জ শুআয়ব আল-জুব্বাঈ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, যে ব্যক্তি এই প্রস্তাব করিয়াছিল তাহার নাম হায়যান। আল্লাহ তাহাকে মাটিতে ধ্বসাইয়া দিয়াছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত সে মাটির নীচে ধ্বসিতে থাকিবে (ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৭৫)।

অতঃপর নমরূদ কাষ্ঠ সংগ্রহ করার নির্দেশ দিল এবং ইবরাহীম (আ)-কে বন্দী করিয়া রাখিল। তাঁহার জন্য একটি পাকা প্রাচীরযুক্ত ইমারত নির্মাণ করিল (ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮১; তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৩-১২৪)। এই সম্পর্কে কুরআন কারীমে বলা হইয়াছে :

“তাহারা বলিল, ইহার জন্য এক ইমারত নির্মাণ কর, অতঃপর ইহাকে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ কর” (৩৭ : ৯৭)।

ইহার পর তাহারা বিভিন্ন প্রকারের কাষ্ঠ সংগ্রহ করিল। এক বর্ণনামতে এক মাস যাবত এই কাষ্ঠ সংগ্রহ অভিযান চলে। ইহাকে তাহারা ধর্মীয় দিক হইতে পূণ্যের কাজ মনে করিত, এমনকি কোন মহিলা রোগাক্রান্ত হইলে তাহা আরোগ্যের জন্য অথবা কোন কাম্য বস্তু পাওয়ার জন্য কাষ্ঠ সংগ্রহ করার মানত করিত (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৩-১২৪; ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮১)। কাষ্ঠ সংগৃহীত হইলে চতুর্কি হইতে তাহারা উহাতে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করিল। এই অগ্নির তেজ এত তীব্র ছিল যে, উপর দিয়া কোন পাখি উড়িয়া যাইতে লাগিলে তাহা পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইত। অগ্নি প্রজ্জ্বলনের পর তাহারা ইবরাহীম (আ)-কে ইমারতের উপরে উঠাইয়া হাত-পা বাঁধিল। অতঃপর ইবলীসের পরামর্শ মত একটি প্রস্তর নিক্ষেপণ যন্ত্র (মিনজানীক) বানাইল এবং ইবরাহীম (আ)-কে উহাতে উঠাইল। তাহারা যখন তাঁহাকে অগ্নিকুণ্ডে ফেলিতে উদ্যত হইল তখন জিন ও মানব ব্যতীত আসমান-যমীন, পাহাড়-পর্বত ও উহার মধ্যে যত সৃষ্টি আছে ফেরেশতাসহ সবাই একবাক্যে চীৎকার করিয়া আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাইল, “হে আল্লাহ! পৃথিবীর বুকে ইবরাহীম ছাড়া আর দ্বিতীয় কেহ নাই যে, তোমার ইবাদত করিবে। তোমার জন্যই তাঁহাকে অগ্নিতে জ্বালানো হইতেছে। তাঁহাকে সাহায্য করিবার জন্য আমাদিগকে অনুমতি দাও।”

তখন আল্লাহ তাআলা বলিলেন, আমি তাঁহার ব্যাপারে অধিক অবগত। সে যদি তোমাদের মধ্যে কাহারও নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে অথবা কাহারো সাহায্য কামনা করে তবে সে যেন তাহাকে সাহায্য করে। আমি তাঁহাকে সেই ব্যাপারে অনুমতি দিলাম । আর যদি আমি ছাড়া অন্য কাহারো সাহায্য প্রার্থনা না করে তবে আমিই তাহার জন্য যথেষ্ট (ইবনুল-আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৭৬)। এক বর্ণনামতে ইবরাহীম (আ)-কে আগুনে নিক্ষেপ করিতে উদ্যত হইলে পানির ফেরেশতা তাঁহার নিকট আসিয়া বলিল, আপনি চাহিলে আমি অগ্নি নিভাইয়া দিব। কারণ পানি ও বৃষ্টির ভাণ্ডার আমার হাতে। বাতাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতা আসিয়া বলিল, আপনি চাহিলে এই অগ্নিকুণ্ড আমি বাতাসে উড়াইয়া দিব। কিন্তু ইবরাহীম (আ) বলিলেন, তোমাদের কাহারো নিকট আমার কোন প্রয়োজন নাই (ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৮১)।

অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মাথা উঠাইয়া বলিলেন, হে আল্লাহ! আকাশে তুমিই একক সত্তা এবং দুনিয়াতে আমি এক ব্যক্তি। দুনিয়াতে আমি ছাড়া আর এমন কেহ নাই, যে তোমার ইবাদত করিবে (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৪; ছালাবী, প্রাগুক্ত)। ইবন কাছীরের বর্ণনা মতে ইবরাহীম (আ) এই বলিয়া দুআ করিয়াছিলেন, “তুমিই আসমানে একক ও যমীনেও একক। আমার জন্য তুমিই যথেষ্ট ও উত্তম কর্মবিধায়ক” (আল কামিল, ১খ, পৃ. ৭৬)। মুমির আরকাম (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবরাহীম (আ)-কে হাত পা বাঁধিয়া যখন তাহারা অগ্নিতে নিক্ষেপ করিতেছিল তখন তিনি বলিলেন,

“তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নাই। তুমি জগৎসমূহের প্রতিপালক, প্রশংসা তোমারই। রাজত্ব ও কর্তৃত্ব তোমারই। তোমার কোন শরীক নাই” (প্রাগুক্ত)। এক বর্ণনামতে তখন জিবরীল (আ) আসিয়া বলিলেন, ইবরাহীম! তোমার কোন প্রয়োজন আছে কি? তিনি বলিলেন, আপনার কাছে কোন প্রয়োজন নাই। জিবরীল (আ) বলিলেন, তবে তোমার প্রতিপালকের নিকট আবেদন কর। তিনি বলিলেন, তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে সব কিছুই অবগত আছেন। তাই তাঁহার অবগতিই যথেষ্ট।

“আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক” (প্রাগুক্ত; ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৪৬)। অতঃপর তাহারা মিনজানীকের সাহায্যে তাঁহাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করিল। তখন আল্লাহ তআলা আগুনকে বলিলেন ।

“হে অগ্নি! তুমি ইবরাহীমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হইয়া যাও” (২১৪ ৬৯)।

সুদ্দীর বর্ণনামতে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে জিবরীল (আ) এই ঘোষণা দিয়াছিলেন (ছালাবী, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৮২)। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি ইবরাহীম (আ)-এর জন্য শীতল ও নিরাপদ হইয়া গেল । শুধু তাহাই নহে, উহা তাহার জন্য পরম আরামদায়ক স্থান হইয়া গেল। তাহার হাত-পায়ের রশিগুলি আগুনে পুড়িয়া তিনি মুক্ত হইয়া গেলেন। আগুনের প্রতি আল্লাহ তআলার উক্ত নির্দেশ শোনার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর সমস্ত অগ্নিই সেই দিন নির্বাপিত হইয়া গিয়াছিল। কাব আল-আহবার, কাতাদা ও যুহরী (র) বলেন, পৃথিবীর বুকে ঐদিন কেহই অগ্নি দ্বারা কোন কাজ করিতে পারে নাই। ইবরাহীম (আ)-এর হাত-পায়ের রশি ব্যতীত অগ্নি ঐদিন কোন কিছুকেই দগ্ধীভূত করে নাই (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৪)। আলী ইবন আবী তালিব ও ইবন আব্বাস (রা) বলেন, আল্লাহ তাআলা যদি তাহার নির্দেশের মধ্যে ১৮ (শীতল) শব্দের পর– (নিরাপদ) শব্দ না আনিতেন তবে অগ্নি এমন ঠাণ্ডা হইয়া যাইত যে, ঠাণ্ডায় ইবরাহীম ইন্তিকাল করিতেন (প্রাগুক্ত)। গিরগিটি (39) ব্যতীত সকল প্রাণীই সেই দিন ইবরাহীম (আ)-এর আগুন নিভাইতে চেষ্টা করে। এই জন্যই নবী (স) উহাকে হত্যা করিবার নির্দেশ দিয়াছেন এবং তাহাকে ক্ষুদ্র দৃষ্কৃতিকারী (a) নামে অভিহিত করিয়াছেন (বুখারী, আস-সাহীহ, কিতাবুল-আম্বিয়া, ৪খ, ৫৯৮)।

ইবরাহীম (আ) ৭ দিন (ইবন আবী হাতিমের বর্ণনায় ৪০ দিন, আম্বিয়া-ই কুরআন, ‘খ., পৃ. ১৯৯) উক্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে অবস্থান করেন। মিনহাল ইবন উমার হইতে বর্ণিত আছে যে, ইবরাহীম (আ) বলিয়াছেন, আমি আগুনের মধ্যে অবস্থানকালীন দিনগুলিতে যে সুখ-স্বচ্ছন্দ ও আরাম-আয়েশ ভোগ করিয়াছিলাম তেমন সুখ-স্বচ্ছন্দ ও আরাম-আয়েশ জীবনে আর কখনো পাই নাই (ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮২)। ইবন ইসহাক প্রমুখ বলেন, আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-এর আকৃতিতে ছায়ার ফেরেশতাকে প্রেরণ করিলেন। তিনি ইবরাহীম (আ)-এর পার্শ্বে আসিয়া উপবেশন করিলেন এবং তাঁহাকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন।

কয়েক দিন পর নমরূদ একটি বাহনে করিয়া সেই অগ্নিকুণ্ডের নিকট দিয়া যাইতেছিল। ইবরাহীম (আ) যে পুড়িয়া ছাইভষ্ম হইয়া গিয়াছেন এই ব্যাপারে তাহার কোনই সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সে তাকাইয়া দেখিল, ইবরাহীম (আ) উহার মধ্যে বসিয়া আছেন। পার্শ্বে তাঁহারই মত এক লোক। সে নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিতেছিল না। সে যাত্রা বিরতি করিয়া ফিরিয়া আসিল এবং তাহার সম্প্রদায়কে ডাকিয়া বলিল, আমি যেন ইবরাহীমকে আগুনের মধ্যে জীবিত দেখিলাম। আমার সন্দেহ হইতেছে। তোমরা আমার জন্য একটি সুউচ্চ স্তম্ভ নির্মাণ কর যেখান হইতে আমি নিম্নে তাকাইয়া অগ্নির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিতে পারি। তাহারা স্তম্ভ নির্মাণ করিলে নমরূদ সেখান হইতে তাকাইয়া দেখিল, ইবরাহীম (আ) একটি ফুল বাগানে বসিয়া আছেন এবং তাঁহার পার্শ্বে উপবিষ্টে তাহারই মত এক লোক অর্থাৎ ফেরেশতাকেও সে দেখিতে পাইল।

নমরূদ ইবরাহীম (আ)-কে ডাকিয়া বলিল, ইবরাহীম! তোমার উপাস্য অতি মহান, যাহার শক্তির ফলে তোমার মধ্যে এবং আগুনের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হইয়াছে। তাই তোমার কোন ক্ষতি হয় নাই। ইবরাহীম! তুমি কি উহা হইতে বাহির হইয়া আসিতে পার? ইবরাহীম (আ) বলিলেন, হাঁ। নমরূদ বলিল, তুমি কি এই ভয় কর যে, তুমি ঐখানে অবস্থান করিলে তোমার কোন ক্ষতি হইবে? ইবরাহীম (আ) বলিলেন, না। নমরূদ বলিল, উঠিয়া দাঁড়াও এবং উহা হইতে বাহির হইয়া আস। ইবরাহীম (আ) উঠিয়া উহার মধ্য দিয়া হাঁটিয়া বাহির হইয়া আসিলেন।

নমরূদের নিকটে আসিলে সে বলিল, ইবরাহীম! তোমার পার্শ্বে উপবিষ্ট তোমারই আকৃতিতে যে লোকটিকে দেখিয়াছিলাম সেই লোকটি কে? ইবরাহীম (আ) বলিলেন, তিনি ছায়ার ফেরেশতা। আমাকে সঙ্গ দিতে আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে আমার নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন। নমরূদ বলিল, হে ইবরাহীম! আমি তোমার উপাস্যের উদ্দেশ্যে কিছু কুরবানী করিব। কারণ আমি তাহার শক্তি ও দৃঢ়তা দেখিয়াছি, যাহা তোমার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করিয়াছেন, যখন তুমি কেবল তাঁহারই ইবাদত কর এবং তাঁহারই একত্ব স্বীকার করা ব্যতীত আর সবকিছুই অস্বীকার করিয়াছিলে। আমি তাঁহার জন্য চার হাজার গাভী যবাহ করিব। ইবরাহীম (আ) বলিলেন, তুমি তোমার এই দীনে থাকাবস্থায় তিনি তোমার কিছুই ককূল করিবেন না, যতক্ষণ না তুমি উহা ত্যাগ করিয়া আমার দীন গ্রহণ কর। নমরূদ বলিল, হে ইবরাহীম! আমি আমার রাজত্ব ত্যাগ করিতে পারি না। তবে শীঘ্রই আমি উহা যবাহ করিব। অতঃপর সত্যই সে উহা যবাহ করিল এবং ইবরাহীম (আ)-কে লূতন কোন শাস্তি দেওয়া হইতে বিরত রহিল। সে ইবরাহীম (আ)-কে বলিল, তোমার প্রতিপালক কতই না উত্তম হে ইবরাহীম! (ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮২-৮৩; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৪; ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ, ৭৬)।

বিবাহ

হযরত ইবরাহীম (আ) কত বৎসর বয়সে বিবাহ করেন তাহা সুস্পষ্টরূপে জানা যায় না। তবে অগ্নিকুণ্ড হইতে বাহির হওয়ার অব্যবহিত পরই তিনি বিবাহ করেন বলিয়া ধারণা করা হয়। স্বীয় চাচাতো ভগ্নি সারা বিনত হারান আল-আকবারকে তিনি বিবাহ করেন। সুদ্দীর বর্ণনামতে সারা ছিলেন হাররান সম্রাটের কন্যা। তিনি তাহার কওমের দীনের ব্যাপারে সমালোচনা করিতেন। ইবরাহীম (আ) যখন শাম অভিমুখে রওয়ানা হন তখন সারার সাক্ষাত পান এবং তাহাকে এই শর্তে বিবাহ করেন যে, তিনি তাহাকে পরিবর্তন করিতে পারিবেন না (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৫; ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৩; ইবনুল জাওযী, তারীখুল মুনতাজাম, ১খ, ২৬২)। তবে হাফিজ ইব্‌ন কাছীর এই মতটিকে বিরল বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। আর কেহ কেহ ধারণা করেন, যেমন সুহায়লী কুতায়বা ও মাকাশ হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, সারা ইবরাহীম (আ)-এর ভ্রাতা হারানের কন্যা, লুত (আ)-এর ভগ্নী। ইহাদের দাবি হইল, তখনকার শরীআতে ভ্রাতুস্পুত্রীকে বিবাহ করা বৈধ ছিল। কিন্তু হাফিজ ইবন কাছীর এই মতটিকে জোরদারভাবে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন যে, ইহা অজ্ঞতার ফল এবং ইহার সপক্ষে কোন প্রমাণ নাই। যদি মানিয়াও লওয়া যায় যে, তখনকার সময়ে উহা বৈধ ছিল, যেমন ইয়াহুদী পণ্ডিতগণ হইতে বর্ণিত আছে, তবুও আম্বিয়া-ই কিরাম উহার উপর আমল করেন নাই। ইব্‌ন কাছীর–এর মতে সারা ইবরাহীম (আ)-এর চাচা হারান এর কন্যা ছিলেন। ইহাই অধিকতর সঠিক ও প্রসিদ্ধ বলিয়া তিনি মত ব্যক্ত করিয়াছেন (ইব্‌ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৫০)।

হিজরত

হযরত ইবরাহীম (আ) স্বীয় পিতা, তাঁহার সম্প্রদায় ও বাদশাহকে অত্যন্ত নম্রভাবে নসীহতের দ্বারা, যুক্তি ও বুদ্ধির দ্বারা বিভিন্নভাবে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিলেন। তাঁহার সহিত শরীক করিতে নিষেধ করিলেন এবং মূর্তিপূজা ত্যাগ করিতে বলিলেন। কিন্তু তাহারা উহা প্রত্যাখ্যান করিল। তাঁহার সম্প্রদায় তাঁহাকে আগুনে ফেলিল। কিন্তু আল্লাহ তাহা ঠাণ্ডা ও নিরাপদ করিয়া দিলেন। আর পিতা তাঁহাকে উক্ত পথ তাগ না করিলে প্রস্তরাঘাতে প্রাণনাশ করার হুমকি দিল। তাঁহার প্রতি কেবল স্ত্রী সারা এবং ভ্রাতুস্পুত্র লুত (আ) ইব্‌ন হারান ব্যতীত আর কেহ ঈমান আনয়ন করিল না (আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৮৩)। ইহাতে ইবরাহীম (আ) ভীষণভাবে মনক্ষুণ্ণ হইলেন এবং স্বদেশ ভূমি ত্যাগ করত অন্যত্র গিয়া দীন প্রচার করিতে মনস্থ করিলেন। তিনি বলিলেনঃ

“আমি আমার প্রতিপালকের দিকে চলিলাম, তিনি আমাকে অবশ্যই সৎ পথে পরিচালিত করিবেন” (৩৭ : ৯৯)।

অতঃপর নিরাশ হইয়া তিনি বাবেলের কৃছা হইতে বাহির হইয়া কালদানীগণের বাসস্থান ফুরাত নদীর পশ্চিম তীরের কাছাকাছি উর নামক একটি জনপদে হিজরত করিলেন। এই সফরে তাঁহার সঙ্গে ছিলেন স্বীয় স্ত্রী সারা ও ভ্রাতুস্পুত্র লুত (আ) (ইব্‌ন কুতায়বা, আল-মাআরিফ, পৃ. ৩২; আবদুল ওয়াহহাব আন-নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৩)। কিছুদিন পর এখান হইতে হারান (হাররান) চলিয়া যান এবং সেখানে দীন-ই হানীফের প্রচার শুরু করেন। এই সময়ে তিনি স্বীয় পিতা আযর-এর হিদায়াতের জন্য দুআ করিতে থাকেন। কারণ অত্যন্ত স্র ও দয়াদ্র হূদয়ের অধিকারী হওয়ার কারণে পিতা কর্তৃক দীন-ই হানীফের দাওয়াত প্রতাখ্যান এবং তাঁহাকে ভর্ৎসনা করা সত্ত্বেও তিনি বলিয়াছিলেন :

“তোমার প্রতি সালাম। আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিব। নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল” (১৯৪৭)।

অবশেষে আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে তাঁহাকে জানাইয়া দিলেন যে, তাঁহার পিতা ঈমান আনয়ন করিবে না, সে আল্লাহর শত্রুই থাকিয়া যাইবে। এই কথা জানার পর ইবরাহীম (আ) তাঁহার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হইতে বিরত থাকেন। কুরআন কারীমে ইহাই সুস্পষ্টভাবে বলা হইয়াছে :

“ইবরাহীম তাহার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়ছিল, তাহাকে ইহার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল বলিয়া। অতঃপর যখন ইহা তাহার নিকট সুস্পষ্ট হইল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন ইবরাহীম উহার সম্পর্ক ছিন্ন করিল। ইবরাহীম তো কোমল হূদয় ও সহনশীল” (৯ : ১১৪)।

বাইবেলের বর্ণনামতে এই সফরে ইবরাহীম (আ)-এর পিতা তারাহ (আযর) ও সঙ্গে ছিল। এই হারানে অবস্থানকালে ২০৫ (মতান্তরে ২৫০) বৎসর বয়সে তারাহ মৃত্যুবরণ করে (Genesis, 11 : 31-32; মুহাম্মদ আল-ফুকা, কাসাসুল-আম্বিয়া, পৃ. ৬১; ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১খ, ১৫০)। এইভাবে দীন-ই হানীফ-এর দাওয়াত দিতে দিতে তিনি হারান হইতে হিজরত করিয়া ফিলিসতীন পৌঁছিলেন। এই সফরেও তাঁহার সঙ্গী ছিলেন স্বীয় স্ত্রী সারা, ভ্রাতুস্পুত্র লূত এবং তাঁহার স্ত্রী কুরআন কারীমে লূত (আ) কর্তৃক ইবরাহীম (আ)-এর উপর ঈমান আনয়ন এবং তাঁহার সহিত হিজরত করার কথা এইভাবে বিবৃত হইয়াছে :

“লূত তাহার (ইবরাহীম-এর) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিল। ইবরাহীম বলিল, আমি আমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করিতেছি। তিনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়” (২৯ ও ২৬)।

আর হাদীছে বর্ণিত হইয়াছে যে, উছমান (রা) যখন স্বীয় স্ত্রী হযরত রুকায়্যা (রা)-কে লইয়া হাবশা হিজরত করেন তখন রাসূলুল্লাহ (স) বলিয়াছিলেনঃ

“নিশ্চয়ই লূত (আ)-এর পর উছমানই প্রথম ব্যক্তি, যে সস্ত্রীক হিজরত করিয়াছে (আবদুল ওয়াহহাব নাজ্জার, কাসাসুল কুরআন, পৃ. ৮৪)।

অতঃপর ইবরাহীম (আ) ফিলিসতীনের পশ্চিমাঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। তৎকালে এই অঞ্চলটি কানআনীদের অধীনস্থ ছিল। অতঃপর নিকটেই শাকীম (বর্তমান নাম নাবলুস) নামক স্থানে চলিয়া যান। আহলে কিতাবের বর্ণনামতে ফিলিসতীনে থাকাকালে আল্লাহ তাহার নিকট ওহী প্রেরণ করেন, তোমার পর এই ভূমিকে আমি বরকতময় করিব। তখন ইবরাহীম (আ) সেখানে একটি কুরবানীর স্থান তৈরি করিলেন এই নিমাতের শুকরিয়াস্বরূপ (Genesis, 12 : 8; ইব্‌ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৫০)। নাবলুসেও তিনি বেশি দিন অবস্থান করেন নাই। আরো পশ্চিম দিকে অগ্রসর হইয়া মিসর চলিয়া যান। মিসরের রাজত্ব ছিল তখন আমালীক সম্প্রদায়ের হাতে রোমানগণ যাহাদিগকে ‘হাকসূস নামে অভিহিত করিত (আবদুল ওয়াহহাব নাজজার, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৪)। কোন কোন ঐতিহাসিকের বর্ণনামতে মিসরের তৎকালীন ফির আওন ছিল অত্যাচারী বাদশাহ আদ-দাহ্হাক-এর ভ্রাতা। দাহ্হাক-এর পক্ষ হইতে সে তখন মিসরের গভর্নর ছিল। আর কাহারও মতে তাহার নাম ছিল সিনান ইবন ‘আলওয়ান ইবন উবায়দ ইব্‌ন উওয়ায়জ ইবন ‘আমলাক ইব্‌ন লাউদ ইব্‌ন সাম ইব্‌ন নূহ (আ)। ইবন হিশাম তাঁহার তীজান গ্রন্থে ‘আমর ইবন ইমরুউল কায়স ইবন মাইনূন (মায়ালশূন) ইবন সাবা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। সে ছিল মিসরে। কোন কোন বর্ণনায় তাহার নাম সাদূফ বা সাদূক বলিয়াও উল্লেখ আছে (ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১খ., ৭৭)। সুহায়লী ইহা বর্ণনা করিয়াছেন (ইব্‌ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৫২)।

ইবরাহীম (আ) স্ত্রী সারাসহ মিসরে প্রবেশ করিলেন। সারা ছিলেন অপরূপ সুন্দরী (তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৫)। আল্লাহ তাআলা তাহাকে সম্মান দিয়াছিলেন। ফিরআওন ছিল দুশ্চরিত্র । কোন এক লোক তাহাকে গিয়া খবর দিল, আপনার রাজ্যের অমুক স্থানে এক লোক আপসয়াছে। তাহার সহিত এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলা আছে। তখন ফিরআওন ইবরাহীম (আ)-কে ডাকিয়া পাঠাইল। ইবরাহীম (আ) তাহার নিকট গেলে ফিরআওন জিজ্ঞাসা করিল, তোমনর সঙ্গের মহিলাটি কে? ইবরাহীম (আ) বলিলেন, আমার ভশ্রী। তিনি আশংকা করিয়াছিলেন যে, স্ত্রী পরিচয় দিলে দুস্তরিত্র ফিরআন তাহাকে হত্যা করিয়া ফেলিবে এবং সারাকে গ্রহণ করিবে । ফিরআওন ইবরাহীম (আ)-কে বলিল, উহাসেজ্জিত করিয়া আমার নিকট পাঠাইয়া দাও। আমি উহাকে সেখিব। ইবরাহীম (আ) সারার নিকট আসিয়া বলিলেন, বাদশাহ আমার নিকট তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করায় আমি বলিয়াছি যে, তুমি আমার ভগ্নী। তাই তাহার নিকট গিয়া অষ্ঠিাকে আবার মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করিও না। কারণ তুমি আমার দীনী ভগ্নী। এই দেশে তুমি আর আমি ছাড়া আর কোন মুমিন ব্যক্তি নাই।

অতঃপর সারা বাদশাহর নিকট গেলেন। এদিকে ইবরাহীম (আ) নামাযে দণ্ডায়মান হইলেন ৷ সারাকে দেখিয়া বাদশাহ বিমোহিত হইয়া গেল এবং তাঁহাকে ধরিতে গেলে তাহার হাত অবশ হইয়া গেল। ইহাতে সে ঘাবড়াইয়া গিয়া বলিল, তোমার প্রতিপালকের কাছে দুআ কর যেন আমার হাত ঠিক হইয়া যায়। আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে আর কষ্ট দিব না। তোমার সহিত সদ্ব্যবহার করিব। সারা তখন দুআ করিলেন। আল্লাহ তাআলা তাহাকে মুক্ত করিয়া দিলেন। সে পুনরায় তাহাকে ধরিতে গেল। এইবারও পূর্বের ন্যায় অথবা তদপেক্ষা কঠিনভাবে হাত অবশ হইয়া গেল । এইবারও বাদশাহ বলিল, আমার জন্য আল্লাহর নিকট দুআ কর, আমি তোমার আর কোন ক্ষতি করিব না। সারা দুআ করিলেন। তাহার হাত ঠিক হইয়া গেল । কোন কোন বর্ণনামতে বাদশাহ তিনবার এইরূপ আচরণ করিয়াছিল এবং তিনবারই সারার দুআয় ভালো হইয়া যায়। অতঃপর বাদশাহ তাহার এক প্রহরীকে ডাকিয়া বলিল, তুমি কোন মানুষ আমার কাছে আন নাই, বরং আনিয়াছ এক ডাইনী (জিন)। বাদশাহ অতঃপর হাজারসহ বেশ কিছু উপটৌকন দিয়া তাহাকে ইবরাহীম ((আ)-এর নিকট পাঠাইয়া দিল। তিনি ইবরাহীম (আ)-এর নিকট ফিরিয়া আসিলেন। ইবরাহীম (আ) তখন নামাযরত ছিলেন। তিনি নামায শেষ করিয়া তাহার দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি খবর? সারা বলিলেন, আল্লাহ তাআলা কাফির দুবৃত্তদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিয়া দিয়াছেন। আর সে হাজারকে খেদমতের জন্য দিয়াছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা) এই হাদীছ বর্ণনা করিয়া বলেন, তিনিই তোমাদের মাতা, হে আরব সম্প্রদায়! (বুখারী, আস-সাহীহ, ৪খ, ২৭০, কিতাবুল-আম্বিয়া; মুসলিম, আস-সাহীহ, ৭, ৯৮-৯৯; ইব্‌ন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১৩, ১৫০; আত-তাবারী, তারীখ, ১খ, ১২৫-১২৬)।

কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায়, সারা ইবরাহীম (আ)-এর নিকট হইতে রওয়ানা হওয়ার পর আল্লাহ তাআলা সারা ও ইবরাহীমের মধ্যে পর্দা তুলিয়া দেন, যাহাতে ইবরাহীম (আ)-এর নিকট হইতে বাহির হওয়ার সময় হইতে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তাহার সকল কর্মকাণ্ড দেখিতে পান। কিভাবে তিনি বাদশাহর নিকট পৌঁছিলেন এবং কিভাবে আল্লাহ তাহাকে হেফাজত করিলেন সব কিছুই তিনি স্বচক্ষে দেখিতে পান। সারার সম্মানার্থে এবং ইবরাহীম (আ)-এর মানসিক প্রশান্তির জন্য আল্লাহ তাআলা এই ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। কারণ সারাকে তিনি অত্যধিক ভালবাসিতেন। কথিত আছে, হাওয়া (আ)-এর পরে তিনিই ছিলেন সর্বাধিক সুন্দরী মহিলা (ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ, ১৫২; ছালাবী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৮৪)। হাজার (রা)-এর পরিচয়