পবিত্র কুরআনে কেবল সূরা আম্বিয়া ৮৫-৮৬ ও সোয়াদ ৪৮ আয়াতে যুল-কিফলের নাম এসেছে। তিনি আল-ইয়াসা [ কুরআনে এই নবী সম্পর্কে সূরা আন’আম ৮৬ ও সূরা সোয়াদ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে অন্য নবীগণের নামের সাথে।
সূরা আন’আম ৮৩ হ’তে ৮৬ আয়াত পর্যন্ত ইলিয়াস ও আল-ইয়াসা’ সহ ১৭ জন নবীর নামের শেষদিকে বলা হয়েছে- ‘ইসমাঈল, আল-ইয়াসা‘, ইউনুস, লূত্ব তাদের প্রত্যেককেই আমরা বিশ্বের উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি’ (আন’আম ৬/৮৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আর তুমি বর্ণনা কর ইসমাঈল, আল-ইয়াসা‘ ও যুল-কিফলের কথা। তারা সকলেই ছিল শ্রেষ্ঠগণের অন্তর্ভুক্ত’। সোয়াদ ৩৮/৪৮ উক্ত বর্ণনায় বুঝা যায় যে, আল-ইয়াসা‘ (আঃ) নিঃসন্দেহে একজন উঁচুদরের নবী ছিলেন।
বংশ পরিচয়
তিনি ইফরাঈম বিন ইউসুফ বিন ইয়াকূব-এর বংশধর ছিলেন। তিনি ইলিয়াস (আঃ)-এর চাচাতো ভাই এবং তাঁর নায়েব বা প্রতিনিধি ছিলেন। হযরত ইলিয়াস (আঃ) সুলায়মান (আঃ) পরবর্তী পথভ্রষ্ট বনু ইস্রাঈলগণের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁর পরে আল-ইয়াসা‘ নবী হন এবং তিনি ইলিয়াস (আঃ)-এর শরীয়ত অনুযায়ী ফিলিস্তীন অঞ্চলে জনগণকে পরিচালিত করেন ও তাওহীদের দাওয়াত অব্যাহত রাখেন। বাইবেলে উনার নাম ‘ইলিশা ইবনে সাকিত’ বলা হয়েছে।] এর পরে নবী হন এবং ফিলিস্তীন অঞ্চলে বনু ইস্রাঈলগণের মধ্যে তাওহীদের দাওয়াত দেন। ‘আর তুমি স্মরণ কর ইসমাঈল, ইদরীস ও যুল-কিফলের কথা। তারা প্রত্যেকেই ছিল সবরকারী’। ‘আমরা তাদেরকে আমাদের রহমতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। তারা ছিল সৎকর্মশীলগণের অন্তর্ভুক্ত’। আম্বিয়া ২১/৮৫-৮৬
ইবলিশ ও যুলকিফল(আঃ)
যুল-কিফল সারা রাত্রি ছালাতের মধ্যে অতিবাহিত করার কারণে কেবলমাত্র দুপুরে কিছুক্ষণ নিদ্রা যেতেন। ইবলীস তাকে রাগানোর জন্য ঐ সময়টাকেই বেছে নিল। একদিন সে ঠিক দুপুরে তার নিদ্রার সময় এসে দরজার কড়া নাড়লো। কাঁচা ঘুম থেকে উঠে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে? উত্তর এল, আমি একজন বৃদ্ধ। তিনি দরজা খুলে দিলে সে ভিতরে এসে বসলো এবং তার উপরে যুলুমের দীর্ঘ ফিরিস্তি বর্ণনা শুরু করল। এভাবে দুপুরে নিদ্রার সময়টা পার করে দিল। যুল-কিফল তাকে বললেন, আমি যখন বাইরে যাব, তখন এসো। আমি তোমার উপরে যুলুমের বিচার করে দেব’।
যুল-কিফল বাইরে এলেন এবং আদালত কক্ষে বসে লোকটির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু সে এলো না। পরের দিন সকালেও তিনি তার জন্য অপেক্ষা করলেন, কিন্তু সে এলো না। কিন্তু দুপুরে যখন তিনি কেবল নিদ্রা গেছেন, ঠিক তখনই এসে কড়া নাড়ল। তিনি উঠে দরজা খুলে দিয়ে তাকে বললেন, আমি কি তোমাকে বলিনি যে, আদালত কক্ষে মজলিস বসার পর এসো। কিন্তু তুমি কালও আসনি, আজও সকালে আসলে না। তখন লোকটি ইনিয়ে-বিনিয়ে চোখের পানি ফেলে বিরাট কৈফিয়তের এক দীর্ঘ ফিরিস্তি পেশ করল। সে বলল, হুযুর! আমার বিবাদী খুবই ধূর্ত প্রকৃতির লোক। আপনাকে আদালতে বসতে দেখলেই সে আমার প্রাপ্য পরিশোধ করবে বলে কথা দেয়। কিন্তু আপনি চলে গেলেই সে তা প্রত্যাহার করে নেয়’। এইসব কথাবার্তার মধ্যে ঐদিন দুপুরের ঘুম মাটি হল।
তৃতীয় দিন দুপুরে তিনি ঢুলতে ঢুলতে পরিবারের সবাইকে বললেন, আমি ঘুমিয়ে গেলে কেউ যেন দরজার কড়া না নাড়ে। বৃদ্ধ এদিন এলো এবং কড়া নাড়তে চাইল। কিন্তু বাড়ীর লোকেরা তাকে বাধা দিল। তখন সে সবার অলক্ষ্যে জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং দরজায় ধাক্কা-ধাক্কি শুরু করল। এতে যুল-কিফলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলেন সেই বৃদ্ধ ঘরের মধ্যে অথচ ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তিনি বুঝে ফেললেন যে, এটা শয়তান ছাড়া কেউ নয়। তখন তিনি বললেন, তুমি তাহলে আল্লাহর দুশমন ইবলীস? সে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমি আজ আপনার কাছে ব্যর্থ হলাম। আপনাকে রাগানোর জন্যই গত তিনদিন যাবত আপনাকে ঘুমানোর সময় এসে জ্বালাতন করছি। কিন্তু আপনি রাগান্বিত হলেন না। ফলে আপনাকে আমার জালে আটকাতে পারলাম না। ইতিপূর্বে আমার শিষ্যরা বারবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। আজ আমি ব্যর্থ হলাম। আমি চেয়েছিলাম, যাতে আল-ইয়াসা‘ নবীর সাথে আপনার কৃত ওয়াদা ভঙ্গ হয়। আর সে উদ্দেশ্যেই আমি এতসব কান্ড ঘটিয়েছি। কিন্তু অবশেষে আপনিই বিজয়ী হলেন।
হজরত যুলকিফল (আ.) আল্লাহর একজন মনোনীত নবী ছিলেন। ইমাম রাজি তার নবী হওয়ার পক্ষে তিনটি প্রমাণ তুলে ধরেছেন। কোরআন শরিফে যে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তিনি তার একজন। কোরআন শরিফে দুই জায়গায় তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আম্বিয়ায় আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, (স্মরণ করো) ইসমাঈল, ইদ্রিস এবং যুলকিফলকে। তারা সবাই ধৈর্যশীল। আর আমি তাদের আমার রহমতের মধ্যে প্রবেশ করিয়েছি। তারা আমার নেক বান্দাদের অন্তর্গত। (সূরা আম্বিয়া : ৮৫-৮৭)। এছাড়া সূরা সাদের ৪৮নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর স্মরণ করো ইসমাঈল, আলইয়াসা এবং যুলকিফলকে। তারা সবাই আমার উত্তম বান্দার অন্তর্গত। (আল কোরআন)।
তাকে এ নামে নামকরণের সার্থকতা তার জীবনের অনেক ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত হয়।
তাফসিরে কুরতুবিতে মুহাম্মাদ বিন কায়েস থেকে একটি বর্ণনা উল্লেখ করা হয় যে, বনি ইসরাইলের মধ্যে একজন নেককার বাদশাহ ছিল। মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে তিনি তার করমকে একত্রিত করে বললেন, কে আমার রাজত্বভার গ্রহণ করতে রাজি আছ? আমি তাকে আমার সব দায়িত্বভার অর্পণ করব। তবে শর্ত হলো, তাকে দিনে রোজা রাখতে হবে, রাতে ইবাদত করতে হবে, আল্লাহর নির্দেশমতো বিচার ফয়সালা করতে হবে এবং কখনও সে রাগ হতে পারবে না। তখন এক যুবক দাঁড়াল। কম বয়স দেখে বাদশাহর পছন্দ হলো না। তাই তিনি আবার ঘোষণা দিলেন। ওই যুবক ছাড়া আর কেউ দাঁড়াল না। বাদশাহ আবারও ঘোষণা দিলেন। এবারও ওই যুবকই দাঁড়ালেন। অবশেষে বাদশাহ তাকে কাছে ডেকে পুরো রাজ্যের দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিলেন। এরপর দীর্ঘদিন ওই যুবক বনি ইসরাইলের বাদশাহি করলেন। এ যুবকই হলেন হজরত যুলকিফল (আ.)। বাদশাহি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন বিধায় তাকে যুলকিফল বা দায়িত্ব গ্রহণকারী উপাধি দেয়া হয়। (তাফসিরে কুরতুবি)।
তাফসিরে কুরতুবিতে হজরত কাব থেকে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করা হয় যে, বনি ইসরাইলের মধ্যে এক কাফের বাদশাহ ছিল। একজন নেককার ব্যক্তি তার কাছে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে গেল। বাদশাহ বলল, আমি ইমান আনলে কী পাব? নেককার লোকটি বলল, জান্নাত পাবে। বাদশাহ বলল, আমার জান্নাতের জিম্মাদার কে হবে? লোকটি বলল, আমি হব। তার কথায় বাদশাহ ইমান আনল এবং এর কিছুদিন পর মারা গেল। তাকে দাফন করা হলো। পরদিন দেখা গেল তার একটি হাত কবরের বাইরে বেরিয়ে আছে এবং তাতে সবুজ একটি চিরকুট।
লোকজন গিয়ে দেখল চিরকুটে নূরের অক্ষরে লেখা রয়েছে, ‘আমাকে আল্লাহ তায়ালা মাফ করেছেন এবং অমুকের জিম্মাদারিতে আমাকে আল্লাহ জান্নাত দান করেছেন। (কুরতুবি)।’ তারিখু মদিনাতি দিমাশক কিতাবে ঘটনা আরও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বাদশাহর নাম কেনান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, এ ঘটনা দেখে ১ লাখ ২৪ হাজার লোক ঈমান গ্রহণ করেছিল। ওই নেককার ব্যক্তি তাদের ব্যাপারেও জান্নাতের জিম্মাদারি গ্রহণ করেছিলেন। এজন্যই তাকে জিম্মা গ্রহণকারী তথা যুলকিফল বলা হয়। ইনিই আল্লাহর নবী হজরত যুলকিফল (আ.)। তার যুলকিফল নামকরণের আর একটা কারণ বলা হয় যে, আল্লাহ তার ইবাদতের ব্যাপারে তার সমসাময়িক অন্য নবীদের চেয়ে দ্বিগুণ সওয়াব দেয়ার ওয়াদা করেছিলেন, এজন্য তাকে যুলকিফল বলা হয়। যেহেতু যুলকিফলের এক অর্থ দ্বিগুণের অধিকারী (কুরতুবি)।
তার প্রকৃত পরিচয় নিয়ে রয়েছে বিস্তর মতভেদ। আধুনিক গবেষকদের মতে, ইহুদিরা যাকে হিজকিল নবী বলে থাকে তিনিই হজরত যুলকিফল (আ.)। মুসলিম প-িতদের অনেকের মতে, তার প্রকৃত নাম বিশর এবং তিনি হজরত আইউব (আ.) এর সন্তান ছিলেন। বলা হয়, হজরত আইউব (আ.) এর পরে তিনি দামেস্ক ও পাশের অঞ্চলে নবী হিসেবে প্রেরিত হন।
তার কবর কোথায় অবস্থিত সে সম্পর্কে রয়েছে একাধিক মত। ১. কারও মতে, দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানে তার মাজার অবস্থিত ২. কারও মতে, সিরিয়ায় ৩. কারও মতে, ইরানে ৪. কারও মতে, ফিলিস্তিনে। আসলে কোরআন শরিফে যে উদ্দেশ্যে নবীদের উল্লেখ করা হয়েছে তার সঙ্গে এ মতভেদপূর্ণ বিষয়গুলোর সংশ্লিষ্টতা নেই। কোরআন শরিফ নবীদের উত্তম আদর্শের উল্লেখ করে তার প্রতি মানুষকে উদ্বুুদ্ধ করতে চায়। কোরআন হজরত যুলকিফল (আ.) কে যে গুণাবলিতে বিশেষিত করেছে তার জীবনচরিত থেকে সেই সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলির আলোচনাকেই আমাদের প্রাধান্য দিতে হবে।